পশু ও পরিবেশ, উভয়েরই পরিত্রাতা ‘ক্লিন মিট’?
জনবিস্ফোরিত বিপুলা এ পৃথিবীর খোরাকি জোগাবে কে? সঙ্গত প্রশ্ন, পল শ্যাপিরোর। তিনি তাঁর বেস্টসেলিং বই ‘ক্লিন মিট’-এও সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। গবেষণাগারে তৈরি ‘পরিচ্ছন্ন মাংস’ই পারে বিশাল এ ধরিত্রীর ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নিবৃত্ত করতে। তাতে রক্ষা পাবে পরিবেশও। শিশু ও নারীকল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গান্ধীও এমত ভাবনার শরিক। হায়দ্রাবাদে এক আলোচনাসভায় তাঁর দাওয়াই: পরিচ্ছন্ন মাংস বহু ঝামেলাকে, মায় ভারতজোড়া গণপিটুনিকেও অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে পারে। মানেকা গান্ধী ক্লিন মিটের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারেও যথেষ্ট আশাবাদী। পরিসংখ্যান মারফৎ তিনি একটি সমীক্ষার উল্লেখ করেছেন। ২০১৮-র জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যদিও সমীক্ষাটি করা হয়েছিল ‘ফনালিটিকস’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থার উদ্যোগে আমেরিকায়, ভারতে নয়। যেখানে ৬৬% মার্কিন নাগরিক ভোট দিয়েছিলেন পরিচ্ছন্ন মাংস বা ‘ক্লিন মিট’-এর পক্ষে। ২৫% ‘ক্লিন মিট’-এর কথা শুনেছেন। ৬৬% মানুষের মধ্যে ৫৩% চান চিরাচরিত পশু-মাংসের বিকল্পে কেবল ‘ক্লিন মিট’কেই।৪৬% প্রত্যহ ‘ক্লিন মিট’ কিনতে চান, ৪০% ‘ক্লিন মিট’-এর জন্য ২৫% বেশি প্রিমিয়াম দিতেও রাজি। ১১৮৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান নাগরিক সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা অবগত ‘ক্লিন মিট’ বা গবেষণাগারে প্রস্তুত মাংস পশুর কোষজাত। মাংসের বিকল্প (যথা: সয়াবিন) কোনও পদার্থ নয়, প্রকৃত মাংসই। যার পুষ্টিগুণ চিরাচরিত জবাই করা মাংসের তুলনায় বহু গুণ বেশি। মানেকা গান্ধীর মতই শ্যাপিরো পশুপ্রেমী, প্রতিষ্ঠাতা ‘কমপ্যাশন ওভার কিলিং’-এর; ‘হিউমেন সোসাইটি অফ দি ইউনাইটেড স্টেটস’-এর তিনি ভাইস-প্রেসিডেন্টও বটে। শ্যাপিরো তাঁর বইতে লিখছেন, সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ পশুকে গৃহপালিত জীবে পরিণত করেছিল তার শ্রম লাঘবে, তার পরে সহজ মাংসের জোগানে সে পশুকে ঘচাং-ফু করতেও কুণ্ঠিত হয় নি। গৃহপালনের প্রশ্নটিসামনে আবারও, তবে এবার গরু বা মুরগির ‘একটা কোষ’ থেকেই মিলবে অঢেল মাংস। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মারা পড়বে না অসহায় মূক প্রাণীটি।
ক্লিন মিট বস্তুটি কী?
পাশ্চাত্যে ক্লিন মিট-এর ধারণাটি নতুন নয়। প্রায় ৮০ বছর আগে ফ্রেডরিক এডউইন স্মিথ ভবিষ্যবাণী করেছিলেন আগামী দিনে একটা সুস্বাদু ‘স্টেক’ খাওয়ার জন্য আস্ত বৃষ পালনের নেই কোনও প্রয়োজন। ১৯৩২-এ উইনস্টন চার্চিল বললেন ‘মুরগির ব্রেস্ট বা ডানা খেতে আর গোটা মুরগির দরকার পড়বে না, এই অঙ্গগুলো আলাদা আলাদা ভাবে কালচার মিডিয়ামে তৈরি করা যাবে’। যে সব পশুর আছে চেরা খুর ও যারা জাবর কাটে তাদের মাংসই ‘ক্লিন মিট’ বলে বাইবেলের লেভিটিকাস অভিহিত করেছে। ‘ক্লিন মিট’ প্রস্তুতকারী সংস্থারাও তাকেই বেদবাক্য মেনেছে। সুতরাং গরু-মোষ-ষাঁড়-ছাগল-ভেড়া-কৃষ্ণসারও অন্যান্য হরিণ, সকলই ক্লিন মিটের পর্যায়ভুক্ত। গবেষণাগারে ক্লিন মিট তৈরি করতে এই সমস্ত পশুদের একটা মাত্র কোষ প্রয়োজন। জৈবপ্রযুক্তি, টিসু কালচারের দ্বারা দু’ধরনের পদ্ধতিতে ক্লিন মিট বানানো যায়। প্রথমটি ‘স্ক্যাফোলড বেসড’ অর্থাৎ ভারা বা মাচার মত একটি আধার তৈরি করে সেই আধারে মাংস প্রতিপালন। যেমন বিস্কুটের পাত্রে আইসক্রিমের কোন, বিস্কুট সমেত আইসক্রিমটি দিব্যি খাওয়া যায়। অন্য পদ্ধতিটি ‘সেলফ অর্গানাইজিং টেকনিক’। হাড়ের সঙ্গে যে মাংস সেই রকম মাংস অর্থাৎ ‘স্কেলিটাল মাস্ল’কে প্রথম গোল্ডফিশের শরীর থেকে সংগ্রহ করেতিন বিজ্ঞানী বেনজামিনসন-গিলক্রিস্ট-লোরেনজ বিভিন্ন কালচার মিডিয়াম, যেমন গরুর ভ্রূণের সিরাম/মাছের খাদ্য/মাশরুম বা ফলজাত নির্যাসে রেখে পরীক্ষা করেছিলেন। মাশরুম নির্যাসে দেখা গেছিল মাংসখণ্ডটি ৭ দিনে ৭৯% পর্যন্ত বেড়েছে। মুরগির মাংসের ক্ষেত্রে দু’মাস পর্যন্ত মাংসের ফিলেটি তাজা ছিল। স্বাদে গন্ধে, মাংসের ত্রিমাত্রিক গড়নে, চর্বির অনুপাতে হুবহু মুরগির মাংসের স্বকীয়তা বজায় থাকলেও গোলটা বাঁধাল ছত্রাক জাতীয় কালচার মিডিয়ামের বিষক্রিয়া। নিরবচ্ছিন্ন ফিলের জোগানে মুরগিটাকে বারেবারে কাটাছেঁড়া করে ‘বায়োপসি’ করার প্রয়োজন পড়ল। ইন-ভিট্রো িমট প্রোডাকশন সিস্টেম বা আইএমপিএস-এ গোড়া থেকেই তাই ‘সেলফ অর্গানাইজিং টেকনিক’ ব্রাত্য, ব্যয়বহুলও বটে।
অগত্যা ‘স্ক্যাফোলড বেসড টেকনিক’-এ স্টেম সেল মারফৎ শুরু হল ‘ক্লিন মিটের’ প্রস্তুতি। প্রাধান্য পেল ‘এমব্রায়োনিক মায়োব্লাস্টস’ ও হাড়ের সঙ্গে যে মাংস তার ‘স্যাটেলাইট সেলস’। আইসক্রিমের বিস্কুটের মত স্টেম সেলকে স্ক্যাফোলডে রেখে তাকে চালান করা হবে ‘বায়ো-রিঅ্যাকটরে’। ভাবা যাক স্টেম হল ধানের বীজ, সেই বীজকে মাটিতে রোপণ করলে জন্মাবে ধানগাছ। অতঃপর মাঠ ভরে যাবে পাকা ধানে। তেমনই স্টেম সেল নামক বীজটিকে রোপণ করা হবে ‘কোলাজেন’ নামক মাটিতে আর ধান চাষের মাঠটি হবে বায়ো-রিঅ্যাকটর। এই পদ্ধতিটির জনক নাসা-র ভ্লাদিমির মিরোনভ। কোলাজেন দিয়ে মাকড়সার জাল বিস্তার করে তার মধ্যে স্টেম সেল বপনের আর একটি পদ্ধতির কথা বললেন উইলেম ভ্যান এলেম। এমব্রায়োনিক স্টেম সেলের ‘মিউটেশন’ ও মায়োস্যাটেলাইট কোষে স্বাভাবিক চর্বির অভাব—ক্লিন মিটের ক্ষেত্রে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করলো। স্বাদ-গন্ধ-চর্বিহীন একঢালা আমসত্ত্বের মত মাংসের থান থেকে স্টেক বা টিক্কা তৈরিও সম্ভব নয়। অ্যাডিপোজ টিসু থাকায় পরিণত স্টেম সেল একমাত্র‘ক্লিন মিট’-এর পক্ষে বিশেষ উপযোগী। অ্যাডাল্ট স্টেম সেলের প্রতিপালন সহজ। ‘ক্লিন মিট’-এর আদর্শ বীজ মিললেও চাষের জন্য মাটিটা অর্থাৎ কালচার মিডিয়ামটাও হওয়া দরকার যথাযথ। মাটি বা মিডিয়াম হিসাবে বাছুরের ভ্রূণের সিরাম বা অ্যামিনো অ্যাসিড পূর্ণ ছত্রাকের নির্যাস নয়, দেখা গেল আদর্শ স্পিগনোসাইন-ওয়ান-ফসফেট। মাংসের স্বাভাবিক কাঠিন্য/নমনীয়তা/খসখসে ভাব বজায় রাখতে নানা রকম পলিমার-কোলাজেন-সেলুলোজ ব্যবহার করা হল। মাংসের বীজ তার মধ্যে বাড়বেও চটজলদি। এর পর স্ক্যাফোলড চলে যাবে বায়ো-রিঅ্যাকটরে। পুঁতির মত দেখতে সাইটোডেস্ক-থ্রি মাইক্রোক্যারিয়ার দিয়ে তৈরি হল বায়ো-রিঅ্যাকটর। অন্তিম পর্যায়ের ফসল সেখানেই ফলবে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বায়ো-রিঅ্যাকটর নিরন্তর বিপুল পরিমাণ মাংসের জোগান দিয়ে যাবে। ২ মাসে ১০টা শূকরের স্টেম সেল থেকে মিলতে পারে অক্লেশে ৫০০০০ টন মাংস। মাংসের তন্তুগুলোকে সুবিধামতো আলাদা করা বা নির্দিষ্ট আকারের মাংসখণ্ড তৈরি, বায়ো-রিঅ্যাকটৱ ছাড়া সম্ভব নয়।
ক্লিন মিটের উপযোগিতা, মূল্য ও প্রস্তুতকারী সংস্থা
‘ক্লিন মিট’ পরিবেশ-বান্ধব। উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের (ডাল, সয়াবিন) তুলনায় গোমাংস থেকে প্রতি একক ভোজ্য-প্রোটিন পেতে ২০ গুণ বেশি জমি লাগে, উদগীরণ হয় ১৮ গুণ বেশি ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জমি পশুচারণভূমি, গোপালনে ব্যবহৃত হয় পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জল। ২০১০-এ দেখা গেছে গোটা কৃষিজ উৎপাদনের অর্ধেক ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ কেবল গৃহ বা খামারপালিত পশুর জাবর কাটার সময় উৎপন্ন হয়েছে। বর্তমানে ‘ক্লিন মিট’ সাকুল্যে ৪% গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি করছে তা অচিরেই আরও কমবে; কমবে ৪৫% পর্যন্তজ্বালানির দহন। জমি লাগবে মাত্র ২%। গো বা অন্যান্য মাংসের তুলনায় রান্না করতে সময় লাগবে কম, ফলে জ্বালানির সাশ্রয় যেমন হবে, বাঁচবে মহিলা-শ্রম। ‘ক্লিন মিট’ নিরাপদ, কারণ কোনও রকম কীটনাশক-অ্যান্টিবায়োটিক-গ্রোথ হরমোন ক্লিন মিটে নিষ্প্রয়োজন। নিখুঁত সুরক্ষাচক্রের মধ্যে গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ায় অবাঞ্ছিত সংক্রমণকে সর্বতোভাবে এড়ানো যাবে। এড়ানো যাবে অ্যাভিয়ান ফ্লু বা ম্যাড কাউ ডিজিসের মত মারণরোগ। সহজেই ফর্টিফাই করা যাবে আয়রন (হিম)-জিঙ্ক-ওমেগা থ্রি ও সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড-ভিটামিন এ, বি-অতি প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ-উচ্চমানের প্রোটিন। হৃদরোগ/ডায়াবেটিসের মত বহু লাইফস্টাইল ডিজিসকে আটকানো সহজ হবে। ‘ভিক্টিমলেস মিট’ হওয়ায় সম্ভব হবে পশুক্লেশ নিবারণ, ‘পেটা’ ১ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করেছে সফল ‘ক্লিন মিট’ উৎপাদনে। বিকল্পের ব্যবহার (এক্ষেত্রে ক্লিন মিট) যতক্ষণ না সহজলভ্য হচ্ছে ততক্ষণ নিবৃত্ত করা যায় না পশুক্লেশ। কেরোসিন সুলভ হওয়ায় তিমির তেলের জন্য তিমিমাছ নিধন বন্ধ হয়েছে। ফোর্ড গাড়ি তৈরি করায় ঘোড়ার অমানবিক ব্যবহার বন্ধ হয়েছে।
২০১৩-র আগস্টে, নেদারল্যান্ডসের মাসট্রিখট ইউনিভার্সিটির ড. মার্ক পোস্ট লন্ডনে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রথম ‘ক্লিন মিট’-এ তৈরি বিফ বার্গার প্যাটি ভক্ষণ করলেন। ২০০০০ মাংসতন্তু থেকে তৈরি বার্গারের খরচ পড়েছিল কাঞ্চনমূল্যে তিন লাখ ডলার। সাড়ে তিন বছর পর সেই বার্গারের বাজারমূল্য দাঁড়ালো ১১.৩৬ ডলার। বর্তমানে ‘ক্লিন মিট’-এ তৈরি বিফ মিটবল, চিকেন টেন্ডার বা ডাক আ-লরেঞ্জের দাম বাজারচলতি মাংসের সমতুল। প্রযুক্তি-প্রকৌশল দুর্মূল্য না হওয়ায় অচিরেই ‘ক্লিন মিট’-এর দাম অন্যান্য জবাই-কৃত অস্বাস্থ্যকর মাংসের তুলনায় অনেকটাই কম হবে।
বর্তমানে বাণিজ্যিক ‘ক্লিন মিট’ তৈরি করছে মেমফিস মিট, মর্ডান মিডো, হ্যাম্পটন ক্রিক, মোজা মিট, ফিনলেস ফুডস, সুপারমিট, ফিউচার মিট টেকনোলজিস, পারফেক্ট ডে, ক্লারা ফুডস, বোল্ট থ্রেডস, ভিট্রোল্যাবস, স্পাইবার, জেলটর ও আরও বহু কোম্পানি। বিশ্ব ক্ষুধা-সুচকে ১১৯টি ক্ষুধার্ত দেশের তালিকায় এই মুহূর্তে ভারতের স্থান ১০০ নম্বরে। বাংলাদেশ ও নেপালও ভারতের আগে। ১৯৯২ তে ২০% শিশু ছিল অপুষ্টির শিকার, ২০১৭র ডিজিটাল ইন্ডিয়ায়‘চাইল্ড ওয়েস্টিং’-এর মান বেড়ে দাঁড়ালো ২১%। ইউনিসেফ-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা মোতাবেক ৫ বছরের নীচে ৫০% শিশুমৃত্যুর কারণ স্রেফ খেতে না পাওয়া। ‘ক্লিন মিট’ নিরন্ন অভুক্ত শিশুর অবাঞ্ছিত মৃত্যুহার কিছুটা হলেও প্রতিহত করবে, নিশ্চয় আগামীতে।
লেখক বিজ্ঞান গবেষক