বায়োফ্লক হলো এমন এক সৃজনশীল ও সাশ্রয়ী উদ্ভাবনী আইডিয়া, এ প্রযুক্তিতে মাছ ও চিংড়ি বা কাঁকড়া, শামুকের জন্য বিষাক্ত বস্তু যেমন নাইট্রেট, নাইট্রাইট, অ্যামোনিয়া পুষ্টিকর খাদ্যে রূপান্তরিত হয়। এ খাদ্যে প্রচুর প্রোটিন বা আমিষ থাকে। এ পদ্ধতিতে চৌবাচ্চা বা বড় ট্যাঙ্কে খুব কম পরিমানে বা একেবারেই পানি পরিবর্তন না করে মাছ চাষ করা যায়। যথেষ্ট এয়ারেশন বা বাতান্বয় রাখা গেলে এবং প্রচুর পরিমানে বায়োফ্লক তৈরি করা গেলে এ খামারে অনেক বেশি ঘনত্বে মাছ চাষ করা যায়। তবে বায়োফ্লক কালচারের হার বাড়াতে চাইলে ট্যাঙ্কটিতে সরাসরি রোদ পড়তে হবে। সরাসরি রোদ ছাড়া ঘরের ভেতরেও এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে উৎপাদন কম হতে পারে।

বায়োফ্লক সিস্টেমে মাছ চাষের কিছু সাধারণ টিপস:

১. ট্যাঙ্কে নামার প্রয়োজন হলে অবশ্যই হাত-পা ভালো করে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিয়ে নামা উচিত। তা না হলে বাইরে থেকে ক্ষতিকর জীবাণু প্রবেশ করে ফ্লক নষ্ট করে দিতে পারে। আবার মাছেরও নানা রোগ হতে পারে। সুতরাং পোল্ট্রি বা গবাদিপশুর খামারের মতো বায়োফ্লকেও হাইজিন মেইনটেইন করা জরুরি।

২. ফ্লক ট্যাঙ্কের তলায় গাদ জমে যেতে পারে। এটি ফ্লক খামারিদের একটি সাধারণ সমস্যা। বেশি পরিমানে খাদ দীর্ঘদিন জমে থাকলে সেখান থেকে অ্যামোনিয়া এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি হয়। এতে গ্যাসের বিষক্রিয়ায় ফ্লক ও মাছ মারা যেতে পারে। েএ কারণে সপ্তাহে অন্তত একবার লাঠি বা শক্ত কিছু দিয়ে ট্যাঙ্কের তলার ফ্লক বা গাদগুলো ভালো ঘুটে দেওয়া দরকার। আপনার ফ্লক ট্যাঙ্ক যদি বড় হয় তাহলে একটি বড় (১০ ফুট বা তার বেশি) ভারী বাঁশের দুই মাথায় দড়ি বেঁধে মইয়ের মতো করে পুরো ট্যাঙ্ক টেনে নিলেও চলে। এতে ট্যাঙ্কের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর থাকে।

 

 

৩. এয়ারেশন ডিফিউজার বা এয়ার স্টোন সপ্তাহে একবার অবশ্যই পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে স্টোনের গায়ে ময়লা বা গাদ জমে গিয়ে এয়ারেশন পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একটি ১০ হাজার লিটার কালচার ট্যাঙ্কে ছোট আকারের (২ ইঞ্চি) স্টোন ১০-১২টি ব্যবহার করা যেতে পারে। আর বড় আকারের (৪ ইঞ্চি) হলে ৬-৮টি ব্যবহার করুন। এসব এয়ার স্টোন আপনি অ্যাকুয়ারিয়ামের দোকানেই পেতে পারেন।

৪. মাছ যদি উপরে ভেসে ওঠে অথবা খাবি খেতে দেখেন তাহলে বুঝবেন পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি পড়েছে। সে সেক্ষেত্রে প্রথমেই এয়ারেশন স্টোন বাড়িয়ে দিতে হবে। এরপর দেখতে হবে ট্যাঙ্কের পানিতে অ্যামোনিয়া ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের ব্যালেন্স ঠিক আছে কিনা। তলায় বেশি গাদ জমে গেছে কিনা সেটিও দেখুন।

৫. যথেষ্ট এয়ারেশন  ব্যবস্থা না থাকলে আরেকটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এয়ারেশনের অভাব হলে ট্যাঙ্কের তলায় ফ্লক জমে যায়।

 

 

৬. প্রতিসপ্তাহে ফ্লকের পরিমান মেপে দেখতে ভুল করবেন না। ফ্লক মাপার জন্য এমহপ কোণ ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো। এমহপ কোণের যদি প্রতি লিটার পানিতে ৩০-৪০ মিলিলিটারের বেশি ফ্লক দেখা যায় তাহলে ট্যাঙ্কের নিচ থেকে পানি বের করে দিতে হবে। িএরপর সমান পরিমান নতুন পরিষ্কার পানি ট্যাঙ্কে প্রবেশ করাতে হবে। হাতের নাগালে এমহপ কোণ না পেলে সাধারণ প্লাস্টিকের বোতর দিয়েও কাজ চলে যাবে। এমহপ কোণ বা বোতলে ট্যাঙ্কের পানি নিয়ে ২০ মিনিট বা আধা ঘণ্টা রেখে দিলেই নিচে ফ্লক জমে যাবে।

৭. মাছ ছাড়ার প্রথম ২০-২৫ দিন ফ্লক প্রতি লিটারে ১০-২০ মিলিলিটারের মধ্যে থাকলেই ভালো। কারণ এসময় মাছ ছোট থাকে আর তাদের ট্যাঙ্কের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও সময় লাগে। তবে মাছ ছাড়ার এক মাস পর থেকে ফ্লক প্রতি লিটারে ৩০-৪০ মিলি থাকতে হবে। যদি এই পরিমান ফ্লক না হয় তাহলে সপ্তাহ একবার করে অ্যাকটিভ প্রোবায়োটিক ছাড়তে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রোবায়োটিক অ্যাকটিভ না করে কখনো ট্যাঙ্কে দেওয়া যাবে না।

৮. বায়োফ্লক ট্যাঙ্কের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অ্যামোনিয়া গ্যাস নিয়ন্ত্রণে রাখা। অতিরিক্ত খাবার ও মাছের মল থেকে প্রতিনিয়ম অ্যামোনিয়া তৈরি হতে থাকে। যথেষ্ট ফ্লক না থাকলে এই ক্ষতিকর মাত্রাতিরিক্ত পরিমানে জমে যাবে। এতে রাতারাতি মারা যাবে পুরো পপুলেশন। অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো কার্বোহাইড্রেড। এ কারণে নিয়মিত মোলাসেস বা চিটাগুড় দিতে হবে।  সাধারণত সরবরাহকৃত খাবারের ৫০% বা অর্ধেক মোলাসেস দেওয়ার নিয়ম। এখন কোনো কারণে যদি ফ্লক যথেষ্ট তৈরি হচ্ছে না বলে মনে হয় তাহলে মোলাসেস এর চেয়ে কমবেশি করে দেখা যেতে পারে। এর কারণ হলো মাছকে যে খাবারটি দৈনিক দেওয়া হচ্ছে সেটিতে কী পরিমান প্রোটিন বা আমিষ আছে সেটি সঠিকভাবে জানাটা মুশকিল।

 

 

৯. বায়োফ্লক সিস্টেমে pH নিয়ে অতোটা মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কারণ সিস্টেমে pH-এর মাত্রা একটু বেশি থাকাই ভালো। কারণ নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া অ্যামোনিয়াকে ভেঙে ফেলার সময় ক্ষার জাতীয় উপাদান ব্যবহার করে। ফলে সিস্টেমে pH-এর মান ৭.২ থেকে ৮.৪-এর মধ্যে রাখা যেতে পারে। তবে এর কম-বেশি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। pH-এর নিয়ন্ত্রণে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো: pH-এর মাত্রা কমে গেলে অর্থাৎ পানি অ্যাসিডিক (অম্লীয়) হওয়ার পথে থাকলে ক্ষার জাতীয় উপাদান ট্যাঙ্কে দিতে হবে। এক্ষেত্রে মাছ চাষের পুকুরে ব্যবহৃত চুন (ডলোমাইট বা শঙ্খচুন) গুলে দেওয়া যেতে পারে। আবার pH-এর মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে অর্থাৎ পানি বেশে ক্ষারীয় হয়ে গেলে অ্যাসিডিক উপাদান যেমন ভিনেগার দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে তেঁতুল বা লেবু গোলা পানিও ব্যবহার করা যেতে পারে।

১০. মাছ ছাড়ার পর ২০-২৫ দিন পেরিয়ে গেলে বা মাছের পোনা ১.২ ‍মিলমিটার আকারের খাবার খেতে পারার মতো বড় হলে ৩-৪ দিন অন্তর অন্তর ট্যাঙ্কের পানি বাড়াতে হবে। অর্থাৎ মনে রাখতে হবে শুরুতেই ট্যাঙ্ক ভর্তি করে পানি দেওয়া যাবে না। এটি নিয়ে অন্য একটি পর্বে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। ধাপে পানি বাড়িয়ে ১০-১৫ দিনে ট্যাঙ্ক ভর্তি করতে হবে। এতে ফ্লক ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের মাত্রায় ভারসাম্য তৈরি হবে।

আরো পড়ুন: