এক সময় গ্রামঞ্চলে গরুর বিকল্প হিসাবে মহিষ পালন করা হতো। বিশেষ করে বোঝাই গাড়ি টানতে কৃষকরা গরুর চেয়ে মহিষের ওপরই বেশি নির্ভর করতেন। কিন্তু মহিষ যে শুধু গাড়ি টানে তা নয়, এর থেকে উপাদেয় দুধ এবং মাংস পাওয়া যায়।
মহিষের গোবর জৈব সারের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। এর হাড় থেকে বিভিন্ন পন্য সামগ্রী যেমন- বোতাম, চিরুনী ইত্যাদি তৈরি করা যায়, তেমনি এ থেকে পশু খাদ্য ও সার পাওয়া যায়। গরুর তুলনায় মহিষের বার্ষিক বৃদ্ধির হার বেশি। এর কারণ হলো মহিষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় এরা অনায়াসে বাঁচতে পারে।
মহিষকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। জলাভূমিতে মহিষ ও নদীর মহিষ। এদরে মোট ১৮টি জাত আছে। এর মধ্যে নিলিরাভী, মুররাহ, সুরটি, জাফরাবাদি, মেহসানা, কুনদি, ভাদোয়ারি এবং ইতালীয় ভূ-মধ্যসাগরীয় মহিষ উল্লেখযোগ্য।
ব্যবস্থাপনাঃ
মহিষ পালন করে আশানুরুপ উৎপাদন পেতে হলে সঠিক ব্যবসথাপনা এবং উপযুক্ত পরিচর্যা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিচর্যার ওপর নির্ভর করে অধিক উৎপাদন। তাপমাত্রার প্রতিকূল অবস্থা থেকে পরিত্রানের লক্ষ্যে মহিষ দিনে প্রায় পাঁচ ঘন্টা পযন্ত পানিতে শরীর ডুবিয়ে রাখে। আর এ শরীর ডুবিয়ে রাখাকে বলা হয় ওয়ালোংয়িং। ওয়ালোয়িংয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে এদের শরীরের তাপতাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য দিনে তিন-চারবার পরিষ্কার পানি ছিটানো প্রয়োজন। পাইপের মাধ্যমে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
মহিষের খাদ্যঃ
১. সঠিক মাত্রায় উৎপাদন পেতে হলে মহিষের জন্য পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য জরুরী। এদের খাদ্য তালিকায় দুই ধরনের খাদ্য যেমন- আঁশযুক্ত খাদ্য ও দানাদার খাদ্য অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
২. সাধারণ ১০০ কেজি ওজনের একটি মহিষের জন্য ২.০-২.৫ কেজি শুষ্ক পদার্থ আঁশযুক্ত ও দানাদার খাদ্য তেকৈ সরবরাহ করতে হবে।
৩. মহিষের খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে প্রত্যেক মহিষ খামারীর বা পালকারীর পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।
৪. মোট শুষ্ক পদার্থের তিন ভাগের দু’ভাগ আঁশযুক্ত খাদ্য ও তিন ভাগের এক ভাগ দানাদার খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।উল্লেখ্য যে, আদি আাঁশযুক্ত খাদ্য যদি গুল্ম জাতের হয় তবে এর পরিমান যথাক্রমে চারভাগের তিন ও চারভাগের একভাগ হতে পারে। আঁশযুক্ত খাদ্যসরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষে উন্নত জাতের ঘাস যেমন; নিপিয়ার, বাজরা, অ্যারোসা, পারা ইত্যাদি বহুবর্ষজীবী ঘাস চাষ করা যেতে পারে।
প্রসবকালীন মহিষের বিশেষ যত্নঃ
১. প্রসকালীন মহিষের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। প্রসবের তিন দনি আগে থেকে ভূষি এবং চিটাগুড় সমৃদ্ধ ল্যাক্সেটিভ এবং হালকা রসদ খাওয়াতে হবে।
২. বাচ্চা প্রসবের জন্য প্রকৃতপক্ষে দুই ঘন্টার প্রয়োজন হয়। এ সময় অতি সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি রাখতে হবে।
৩. প্রথম বাচ্চা প্রসবকারী গাভী এক বা একাধিক বাচ্চা প্রসবকারী মহিষের তুলনায় বেশি বিচলিত থাকে। সুতরাং প্রথম বাচ্চা প্রসবকালে গাভীর কাছে না থেকে দূরে থেকে লক্ষ রাখতে হবে।
৪. বাচ্চা প্রসবের পরেই গাভীর শরীরের পেছনের অংশ কুসুম গরম পানি দ্বারা ভালোভাবে পরিষ্কার করে দিতে হবে।
৫. বাচ্চা প্রসবের পরপরই গাভীকে কুসুম গরম পানি খাওয়াতে হবে। এরপর ভূষি, গমভাঙ্গা অথবা কর্ণ গুড়, লবণ, আদা এবং সামান্য পরিমাণ খনিজ জাতীয় খাদ্য উপাদানের সমন্বয়ে জাউ করে খাওয়াতে হবে।
৬. বাচ্চা প্রসের চার-ছয় ঘন্টার মধ্যে ফুল বের হয়ে আসে। ফুল বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিয়ে মাটিতে পূঁতে ফেলতে হবে।
বাচ্চার বিশেষ যত্নঃ
বাচ্চার জন্মের পর বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
১. গরুর তুলনায় মহিষের জন্য বাসস্থান নির্মাণে তেমন কোন খরচ হয় না। কারণ গরুর মতো মহিষের জন্য ব্যয়বহুল ঘর তৈরির প্রয়োজন নেই।
২. মহিষ সাধারণ ছায়ায় থাকতে পছন্দ করে।
৩. পারিবারিকভাবে অল্প সংখ্যক মহিষ পালনের ক্ষেত্রে অতি ঠান্ডা ও গরেমর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ছাউনি তৈরি করা যেতে পারে। এ ছাউনি গাছের নিচে বা ছায়া যুক্ত স্থানে নির্মাণ করা উত্তম।
৪. ছাউনি তৈরির উপকরণ হিসাবে বিভিন্ন অঞ্চলে সহজপ্রাপ্য উপকরণ যেমন, ছন, নারিকেল গাছের পাতা, পাটের সোলা ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
৫. মহিষের সংখ্যা বেশি হলে খামারে আধাপাকা ঘর তৈরি করা যেতে পারে। সঙ্গে ঘরের মেঝেটাও পাকা করা ভালো।
৬. প্রতিটি ঘরের ড্রেন বা নালা থাকতে হবে এবং ড্রেনগুলো সরিয়ে নেওয়া যায় এমন স্লাব তৈরি করে ঢেকে দিতে হবে।
৭. ঘরের ছাদ টিন, বাশ করোগেটেড সিট অথবা ইট দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে।
৮. খোলা অনাচ্ছাদিত জায়গায় ছায়াদনকারী গাছ লাগনো যেতে পারে, যা পশুকে শীতকালে সরাসরি ঠান্ডা বাতাস এবং গরমকালে সূযের তাপ তেকৈ রক্ষা করবে।
৯. গভীর ঘরের একপাশে খাবার ও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাকি তিন দকি পাঁচ ফুট উঁচু করে দেয়াল তৈরি করতে হবে।
১০. ঘরের সামনে উন্মক্ত (ছাদবিহীন) জায়গায় তিন ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে চারদিক বন্ধ করে এক পাশে গেট রাখতে হবে।
উপকরণ যেমন- ছন, নারিকেল গাছের পাতা, পাটের সোলা ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
সূত্র- আধুনিক কৃষি খামার।