গরু-ছাগল বা অন্যান্য পশুর খামার করতে চাইলে নিজস্ব জমিতে উন্নত জাতের ঘাস চাষের কোনো বিকল্প নেই। নিজের জমিতে পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাস না থাকলে সেই খামারির লাভ করতে পারাটা প্রায় অসম্ভব। আর কাঁচা ঘাস যথেষ্ট না পেলে গরু-ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে মোটাতাজাকরণ হোক আর দুগ্ধ খামার হোক উৎপাদন কখনোই আশানুরূপ হবে না।

আর আমরা সবাই জানি, সবচেয়ে লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষি প্রকল্প হলো সমন্বিত খামার। অর্থাৎ একটি প্রকল্পের মধ্যে পশু খামার, পোল্ট্রি এবং মৎস্য খামার করা। এতে অনেক সাশ্রয় হয়।

 

 

এই ধরনের খামারকে আরও বেশি সাশ্রয়ী করতে চাইলে একই কাঁচা ঘাস গরু-ছাগল এবং মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে।

 

 

কি, অবাক হচ্ছেন! অবাক হওয়ার কিছু নেই।  কয়েক প্রজাতির মাছ ঘাস লতাপাতা খায়। এরা যে পেটের দায়ে ঘাস খায় তা কিন্তু নয়। এদের প্রাকৃতিক খাবারই হলো ঘাস লতাপাতা।

ঘাস খাইয়ে মাছ পালনের বিষয়ে পয়েন্ট আকারে কিছু তথ্য নিচে দেওয়া হলো:

১. গ্রাস কার্প ও সরপুঁটি ঘাস খায়। নরম ঘাস বা সবজি কুচি করে কেটে দিলে এরা মজা করে খায়। ঘাস খাওয়া মাছ বাড়েও দ্রুত।

২. ঘাস খাওয়ার পরে মাছেরা যে মলত্যাগ করে সেটিও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এই মল আবার অন্যান্য মাছে খাদ্য। যেমন, fish dung বা মৎস্য মল সিলভার কার্প মাছের প্রিয় খাবার। ফলে পুকুরে কয়েক স্তরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ থাকলে কিন্তু আলাদা করে আর গরুর গোবর দেওয়ার দরকার পড়বে না।

৩. ঘাস প্রয়োগ করার ২-৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘাসের গায়ে ‘পেরিফাইটন’ (Periphyton) নামে একটি পদার্থ জমতে থাকে বা সৃষ্টিও হতে শুরু করে। এটি মাছের ভক্ষণযোগ্য আমিষ জাতীয় পদার্থ। অধিকাংশ মাছেরই পছন্দের খাবার।

৪. যথেষ্ট ঘাস (শতকে ১ কেজি হিসাবে) প্রয়োগ করলে মাছ খাক বা না খাক ঘাসের পচন (Decomposition) শুরু হলে তার নির্যাস জৈব সার হয়ে যায়। ফলে পানিতে প্রচুর জুয়োপ্লাঙ্কটন তৈরি হয়। এই জুয়োপ্লাঙ্কটন সব ধরনের মাছের আমিষ জাতীয় খাবার সরবরাহ করে।

৫. ঘাস যখন আধ-পচা (Semi decomposed) হয় তখন রুই মাছের বিশেষ পছন্দনীয় খাবারে পরিণত হয়। এই ধরনের খাবার খেলে রুই মাছের রঙ মেরুন-লাল রঙের হয়। আর আমরা সবাই জানি বাজারে গেলে মানুষ লাল রুই খোঁজে। ফলে এই রঙের রুইয়ের দামও বেশি।

৬. ঘাসের ঝুলন্ত (Suspended) এবং সূক্ষ্ণ অংশে (Fine particle ) প্রচুর ‘ব্যাকটেরিওপ্ল্যাঙ্কটন’ বংশবিস্তার করে ও উৎপাদিত হয়; যা মাছের উচ্চ মানের আমিষের প্রয়োজন মেটায়।

৭. ঘাস পুরো পচে গেলে (Completely decomposed) মৃগেল ও কাতলা মাছ খেয়ে থাকে।

৮. পচে যাওয়া ঘাসের তলানিতে ‘কাইরোনমিড’ (Chironomid) বংশ বিস্তার করে মাছের (বিশেষ করে কার্পিও/ মিরর কার্প ও মৃগেলসহ তলায় বা নিচের স্তরে বসবাসকারী মাছ) আমিষ জাতীয় খাবারের জোগান দেয়। কাইরোনমিডের খাদ্যে রূপান্তরের হার হলো গ্রহণকৃত খাদ্যের প্রায় ৭৫%। যেখানে অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য রূপান্তরের হার ২২-৩০% এর বেশি নয় ।

৯. ঘাসের মধ্যে ‘ভিটামিন বি’ এর উপস্থিতি প্রোফাইল এত প্রশস্থ যে চমকিত হওয়ার মতো। এই ‘ভিটামিন বি’ মাছের খাদ্য হজম ও আত্তীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

১০. ঘাসকে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করলে পুকুরের পানিধারণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।

 

 

১১. ঘাস ব্যবহার করলে পানির রঙ সুন্দর সবুজ/নীলচে থাকবে। পুকুর পানি এই রঙে থাকলে সেটিকে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বলা যেতে পারে।

১২. ঘাস প্রয়োগকৃত পুকুরের মাছের স্বাদ, গন্ধ ও রঙ একেবারেই প্রাকৃতিকভাবে বড় হওয়া মাছের মতো। মনে হবে যেন বিল বা হাওড়ের মাছ খাচ্ছেন!

১৩. পুকুরের ৫-৮% জায়গায় কচুরিপানা বা অন্যান্য জলজ ঘাস জন্মানোর সুযোগ দিলে মাছ চাষিরা যে সুবিধাগুলো পাবেন:

ক. পানার শিকড় অথবা জলজ ঘাসে ‘পেরিফাইটন’ জমা বা সৃষ্টি হবে

খ. কচুরিপানার উপস্থিতি জুওপ্ল্যাঙ্কটনের বংশবৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক (Friendly)। দেখা গেছে এর চার পাশে ‘জুওপ্ল্যাঙ্কটনের’ ডিমগুলো ‘কেরোসিন’ তেলের মতো ভাসতে থাকে।

গ. গোবর বা জৈব সারের জন্য বাড়তি পয়সা গুনতে হবে না

ঘ. প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও মাছ স্বাভাবিক জৈবিক ক্রিয়ার ভিতরে থাকবে।

ঙ. প্রচণ্ড শীতেও মাছ কম কষ্ট পাবে।

চ. তাপের প্রভাবে পুকুরের পানির জলীয় বাষ্পে পরিণত হওয়া কমাবে। এতে পুকুরে বেশি দিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি থাকবে।

ছ. মুক্ত অ্যামোনিয়া ঘাস বা পানার শিকড় দিয়ে শোষিত হওয়ায় ‘অ্যামোনিয়াজনিত বিষাক্ততায়’ (Ammonia toxicity) মাছের মৃত্যুর ঝুঁকি কমবে।

জ. পানি পরিষ্কার থাকবে।

ঝ. মাগুর-শিং মাছের আশ্রয়স্থল হিসাবে কাজ করবে।

ঞ. জলজ ঘাসের শিকড়ে জন্ম নেওয়া ও লুকিয়ে থাকা প্রাণীকূল (কেঁচো ও কাইরোনমিড দলভুক্ত) মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

মনে রাখতে হবে- দেশি ঘাসের পাশাপাশি উন্নত জাতের ঘাস চাষ করতে হবে। নেপিয়ার, ইপিলইপিল, জার্মান, পাকচং ইত্যাদি উন্নতজাতের ঘাসগুলো দ্রুত বড় হয় এবং বেশি ফলন দেয়। ফলে মাছ চাষের জন্য এসব ঘাসের আবাদ করতে হবে। এই উন্নতজাতের ঘাসগুলো একদিকে দ্রুত বর্ধনশীল সেই সঙ্গে দেশি ঘাসের চেয়ে পুষ্টিগুণও অনেক বেশি।