মাছ মোটা-তাজাকরণ:
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এক বিশেষ পদ্ধতিতে শুরু হয়েছে রুই জাতীয় মাছের চাষ। মাছ চাষের এই পদ্ধতির নাম কার্প ফ্যাটেনিং। সোজা কথা মাছ মোটা-তাজাকরণ। এতে মাছ বাড়ে দ্রুত। উৎপাদনশীলতাও খুব বেশি। পুকুরে চাষ করার সময় মাছের রোগ-ব্যাধিও কম। তথ্য মতে, এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা।
জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম-ফেজ (এনএটিপি ২)-এর পিবিআরজি প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প প্রভৃতি কার্পজাতীয় মাছের গবেষণা কার্যক্রম বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলাতে চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন এই প্রযুক্তির গবেষণায় গবেষকরা দক্ষিণাঞ্চলে মাছ চাষে নতুন এক সফলতা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় তিন বছর ধরে চলা নতুন এই কার্পফ্যাটেনিং প্রযুক্তি উপ-প্রকল্পের প্রধান গবেষক হলেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুয়াকালচার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক এবং সহকারী প্রধান গবেষক হিসেবে আছেন ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল আলম। উপ-প্রকল্পটির সার্বিক অর্থায়নে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এনএটিপি-২ প্রকল্প। এই উপ-প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী অঞ্চলে কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের প্রফেসর ড. মোহা. আখতার হোসেন এবং প্রফেসর ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান মন্ডল।
বাজারে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কমন কার্প প্রভৃতি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই জাতীয় মাছ দ্রুত বড় হয়, রোগাক্রান্ত কম হয়, খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অপরের প্রতিযোগী নয়, পানির সব স্তর থেকে প্রাকৃতিক খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। তাই পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে এবং সর্বোপরি এসব মাছ খেতে সুস্বাদু। দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্যচাষিরা সাধারণত ছোট আকারের এই জাতীয় মাছ পুকুরে মজুদ করেন। এই ছোট আকারের মাছগুলোর বাজারজাতের উপযোগী হতে সাধারণত দুই থেকে তিন বছর সময় লাগে। এছাড়া ছোট আকারের মাছ পুকুরে মজুদ করলে মাছের মৃত্যুহারও অধিক হয়।
কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে সাধারণত বড় আকারের যেমন ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের কার্পজাতীয় মাছ পুকুরে মজুদ করা হয়। এতে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য প্রযোগ করে সাত থেকে আট মাসেই মাছ বাজারজাত করা হয়, যা দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্যচাষিদের কাছে ছিল অকল্পনীয়। কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে মৎস্যচাষিরা মাছ চাষ করে অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া চাষিদের মাঝে মাছ চাষের ব্যাপক আগ্রহও সৃষ্টি হয়েছে।
কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে গবেষকরা দুটি গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। প্রথম গবেষণাতে পানির স্তরভেদে কার্পজাতীয় মাছের সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন। দ্বিতীয়, গবেষণাতে কার্পজাতীয় মাছের মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ করেছেন। তৃতীয়, গবেষণাতে কার্পজাতীয় মাছের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সম্পূরক খাদ্য নির্ধারণে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া পানির গুণাগুণ পরীক্ষা, প্লাংটনের প্রাচুর্যতা, মাছে ও পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি, মাছ ও পানিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে গবেষকরা কাজ করছেন। কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির পাশাপাশি উপ-প্রকল্প এলাকায় গ্রামীণ মহিলাদের সম্পৃক্ত করে ছোট আকারের জলাশয়ে শিং, মাগুর, গুলশা মাছ নিয়েও গবেষকরা গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তি উপ-প্রকল্পের মাধ্যমে সুফলভোগীদের মাঝে মাছ চাষের সব উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মৎস্যচাষিরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং রাজশাহী অঞ্চলে কার্প ফ্যাটেনিং কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন।
উপ-প্রকল্পের সুফলভোগী মো. মিলন খলিফা জানান, কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের এই অঞ্চলের মৎস্যচাষিদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করে আমরা অনেক লাভবান হয়েছি এবং এই প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করে অন্যরাও লাভবান হবেন বলে বিশ্বাস করি। আরেক সুফলভোগী মো. শামীম মাতব্বর জানান কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষে আমার নিজের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে এবং আশপাশের মানুষের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।
উপ-প্রকল্পের সহকারী প্রধান গবেষক ড. মো. আরিফুল আলম জানান, কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে মাছ চাষের ফলে কোস্টাল অঞ্চল তথা পুরো দক্ষিণাঞ্চলে কার্পজাতীয় মাছ চাষে বিপ্লব ঘটে যাবে এবং মৎস্যচাষিদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এ ব্যাপারে উপ-প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক জানান, কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির প্রধান বাধা স্থানীয়ভাবে বড় আকারের কার্পজাতীয় মাছের অপ্রতুলতা-স্থানীয় নার্সারিগুলোতে বড় আকারের পোনা উৎপাদনসহ মৎস্যচাষিরা চাপের পোনা কিছু সময় লালন করে পুকুরে মজুদ করলে দক্ষিণাঞ্চলে কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন আরো ব্যাপক হারে বাড়বে।
প্রসঙ্গত, মাছ হচ্ছে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং পুষ্টি সরবরাহে মাছ চাষের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও-এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চাষের ও প্রাকৃতিক উৎসের মাছ মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। ২০২০-২১ সনে দেশের বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রক্ষেপিত মৎস্য চাহিদা ৪৫ দশমিক ২৮ লাখ টন। প্রক্ষেপিত মৎস্য চাহিদা পূরণে চাষের মাছ অন্যতম ভূমিকা পালন করবে।
পোস্ট :হাসিবুর রহমান (বরিশাল অফিস)
সংগৃ্হিত