ড. মো. আব্দুল মালেক
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি, তাই কৃষির উন্নয়ন কৃষকের উন্নয়নের পথকে সুগম করে। কৃষিভূমির প্রতিটি ইঞ্চি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিবিড়ভাবে চাষাবাদের মাধ্যমে দেশের কৃষিতে নববিপ্লব ঘটানো সম্ভব। এ দেশের মাটি ভৌগোলিকভাবেই কৃষিবান্ধব হওয়ায় কৃষি খাত এ দেশকে করেছে সমৃদ্ধ। স্বাধীনতা লাভের সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি, আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ কোটিতে। ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার বিপরীতে ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি আর বৈরী জলবায়ু মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে এ দেশের কৃষি। ফলে কৃষির উন্নয়ন আজ দৃশ্যমান। কৃষিবিজ্ঞানীদের ফসলের নতুন নতুন উন্নত জাত উদ্ভাবন, কৃষক পর্যায়ে দ্রুত সম্প্রসারণ আর কৃষকের কঠোর শ্রমে সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষি জোগান দিচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠীর আহার, দূর করেছে দারিদ্র্য আর সাহস জুগিয়েছে বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলা করে টিকে থাকার কৌশল। বিশ্বের অনেক দেশই মনে করে বাংলাদেশ সংকট মোকাবেলায় একটি মডেল। খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করছে। দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে টেকসই করে ভবিষ্যতে আরো এগিয়ে নিতে দেশের কৃষিকে পরিকল্পনামাফিক ঢেলে সাজাতে হবে।
ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রয়োজন উচ্চফলনশীল জাত, উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনা এবং ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন খরচ এবং কর্তনোত্তর ক্ষতি কমিয়ে দেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাছাড়া জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায়ও যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষক পর্যায়ে ধান রোপণে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ও সংগ্রহে কম্বাইন হারভেস্টারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি প্রদান করছে, যা সূচনা করছে কৃষির যান্ত্রিকীকরণে। কাজেই যান্ত্রিকীকরণের সুফল পেতে ধানের মতো অন্যান্য ফসল আবাদেও যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। কারণ কৃষিকে একটি লাভজনক ও জনপ্রিয় পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া ফসল উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে যান্ত্রিকীকরণ করতে পারলে বর্তমানে দেশের শ্রমিক সংকটকালে স্বল্প শ্রমিক দিয়েই কৃষিকে এগিয়ে নেয়াও সহজতর হবে।
ফসলের ফলন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো উন্নতমানের বীজ। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে দেখা যায়, ২০২২-২৩ বছরে বিভিন্ন ফসলের মোট বীজের চাহিদা ১২ লাখ ১০ হাজার ৩৫১ টন হলেও বিএডিসি, ডিএই ও বিএমডিএর উৎপাদিত বীজ এবং বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে উৎপাদিত ও আমদানীকৃত বীজের পরিমাণ ৩ লাখ ৬১ হাজার ২৬৪ টন, যা মোট দেশীয় চাহিদার মাত্র ৩০ শতাংশ। শস্যভিত্তিক বিবেচনায় ধান, গম, ডাল ও তেল ফসলের ক্ষেত্রে এর শতকরা হার যথাক্রমে ৬৪, ৪৩, ১২ ও ২১ অর্থাৎ ধান বীজের চাহিদার ৩৬ শতাংশ, গমের ৫৭, তেল বীজের ৮৮ ও ডালের ৭৯ শতাংশ বীজের উৎপাদন কৃষক পর্যায়ে হয়ে থাকে। ফসল উৎপাদনে কৃষক নিজস্ব যে বীজ ব্যবহার করেন তার গুণগত মান সন্তোষজনক নয়। এটা পরীক্ষিত যে মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারে ফলন তথা উৎপাদন শতকরা ১৫-২০ ভাগ বাড়ানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে ফসলের ফলন তথা মোট উৎপাদন বাড়াতে উন্নত ও গুণগত মানের বীজের কোনো বিকল্প নেই।
উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন বীজ সরবরাহে নিম্নের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে:
১. বিএডিসি ও বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে উন্নত মানের বীজের সরবরাহ বৃদ্ধি করা; ২. বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির সক্ষমতা বাড়িয়ে কৃষক পর্যায়ে উন্নত মানের বীজ উৎপাদন নিশ্চিত করা; ৩. কৃষক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক উন্নত মানের বীজ উৎপাদন নিশ্চিত করা এবং ৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারি ও কৃষক পর্যায়ে বীজের আপৎকালীন মজুদ নিশ্চিত করা।
১৯৭১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৪৮ বছরের ব্যবধানে দেশে ধান চাষের আওতায় জমি ২০ শতাংশ কমলেও উচ্চফলনশীল জাতের প্রবর্তন ও কৃষির উন্নত সব প্রযুক্তির সমন্বয়ে ধানসহ বিভিন্ন দানাদার ফসলের উৎপাদন বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। তবে দেশের কৃষির এ সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন এবং এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে কৃষি ক্ষেত্রে। তাই জলবায়ুর প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিভিন্ন ফসলের প্রতিকূলতা সহনশীল জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। এজন্য দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে হবে। তাছাড়া কৃষি গবেষণায় বাজেটের পরিমাণ অনেকাংশে বাড়াতে হবে।
ফসলে পোকা শতকরা ১৩ ভাগ ও রোগ ১২ ভাগ ক্ষতি করে থাকে এবং আগাছাও ফলন কমিয়ে দেয়। তাই ফসল উৎপাদনে রোগ, পোকা ও আগাছা দমনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। ফসল উৎপাদনে সার খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা ফসলের ফলন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সারা দেশের মাটিতেই ফসলের বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি রয়েছে। তাই ফসল উৎপাদনে মাটিতে সুসম সারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রণীত ‘সার সুপারিশমালা গাইডবুক’ অনুসরণ করতে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে।
ফসলের ফলন বাড়াতে পানির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। খরা মৌসুমে পানির ব্যবস্থা করতে না পারলে ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া শুকনো রবি মৌসুমে কিছু ডাল ফসল ছাড়া সব ফসলেই পানি সেচের প্রয়োজন। তাই ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো জন্য সেচ ব্যবস্থাকে যান্ত্রিকীকরণের আওতায় আনতে হবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধ করতে হবে।
কৃষি দেশের বৃহত্তম গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা। দেশের অধিকাংশ মানুষই জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই গ্রামীণ উন্নয়নে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে সরকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ এ শিল্প গ্রামীণ জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এ শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের বাণিজ্যিকীকরণে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কাজেই কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বাড়তি আয়ে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ অপরিহার্য। বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কৃষি পরিচালিত হওয়াকে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বোঝায়। উৎপাদিত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন ও রফতানি বাড়াতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। যেসব কৃষিপণ্য আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় এবং উৎপাদন খরচও কম, যেমন আলু ও শীতকালীন সবজি, আম এবং কিছু উচ্চ মূল্যের শস্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিকীকরণের যথেষ্ট সুযোগ আছে। সে লক্ষ্যে মানসম্পন্ন ও নিরাপদ কৃষিপণ্য দেশে উৎপাদন করে রফতানিতে সরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকার করোনাকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে প্রণোদনা দিয়েছে এবং সারের মূল্য ভর্তুকি দিয়েছে। বিএডিসি নির্ধারিত বিক্রয়মূল্যের কম দামে আমনের উফশী ও হাইব্রিড বীজ বিক্রিতেও ভর্তুকি দিয়েছে। এ প্রণোদনা ও ভর্তুকি সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। তাই কৃষি উন্নয়ন টেকসই করাসহ এগিয়ে নিতে সরকারকে কৃষির বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে হবে।
করোনাকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, যার একটি হচ্ছে ‘খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। অধিক ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যা যা দরকার করতে হবে। কোনো জমি যেন পতিত না থাকে।’ এজন্য সম্ভাব্য খাদ্যসংকট মোকাবেলায় খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। চেষ্টা চলছে যাতে দেশে খাদ্য আমদানি করতে না হয়। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বসতবাড়িসহ আঙিনায় বিভিন্ন সবজি ও ফল ফলাতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করছেন। দেশের ১ দশমিক ৩৫ কোটি কৃষিবহির্ভূত পরিবারকেও বাড়ির আঙিনাসহ ছাদকৃষিতে উদ্বুদ্ধ করে সবজি, ফল ও মসলা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
কৃষির উন্নয়নে অপরিহার্য শর্ত হলো উন্নত বিপণন ব্যবস্থা। বিপণন ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকলে বাড়তি উৎপাদনে মূল্য হ্রাস পাওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। দক্ষ বিপণন ব্যবস্থা কৃষককে কৃষিপণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করে। কৃষক উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার কাছে বিক্রির মাধ্যমে সর্বোচ্চ আয় নিশ্চিত করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ শতভাগ বাস্তবায়ন হলে কৃষকরা ঘরে বসেই সারা বিশ্বের কৃষি সম্পর্কিত তথ্য মুহূর্তেই জানতে পারবে এবং বিপণনের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে।
কৃষি উৎপাদন টেকসই করে ভবিষ্যতে উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। এজন্য কৃষকের উৎপাদন ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য শস্য বীমার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কৃষকরা কৃষিপণ্য উৎপাদনে আগ্রহী হন। তাই দেশের কৃষি উন্নয়নে শস্য বীমা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, আমাদের সংবিধানে গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবকে যে অর্থে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে আমরা প্রকৃত অর্থে এ মৌলনীতির সার্থক বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতে পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়নসহ কৃষকের জীবনযাত্রার আরো উন্নয়ন ঘটবে।
ড. মো. আব্দুল মালেক: মহাব্যবস্থাপক, সমন্বিত কৃষি ইউনিট পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)
বণিক বার্তা