ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন
যখন থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন পৃথিবীব্যাপী একটি সমস্যা হিসেবে আমাদের আবেগ ও বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে, তখন থেকে আমাদের নেতারা আমাদের বলেই যাচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিবেশগত হুমকি এবং মানব জাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা থেকে দ্রুততম সময়ে আমাদের বের করে আনার জন্য কেউ সর্বসম্মত কোনো পথ বা মত দিতে পারছেন না যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনুভূত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে সব কমিউনিটিতে। ১৯৭০ সাল থেকে প্রতি দশকে গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েই চলছে এবং রেকর্ড বলছে সবচেয়ে উষ্ণ ১০টি বছরই আমরা পেয়েছি ১৯৯৭ সালের পর থেকে। চলতি বছর আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে উষ্ণতম বছর হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আমরা অসহনীয় তাপ, অসহ্য বাতাস, প্লাবিত উপকূলীয় অঞ্চল, ব্যাপক খরা এবং ধ্বংসাত্মক বন্যার অবাসযোগ্য পৃথিবী আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে হবে। এ বিষয়ে একটি অস্ট্রেলিয়ান থিংক ট্যাংক সতর্ক করেছে যে জলবায়ু পরিবর্তন সভ্যতার অবসান ঘটাতে পারে কয়েক দশকের মধ্যে।
উন্নত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের অত্যাধুনিক পৃথিবীতে আমরা এরই মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ছাড়াই বা খুব কম পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন নিশ্চিত করে আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করার ক্ষমতা অর্জন করেছি। এগুলো হচ্ছে সবুজশক্তি যেমন সৌর, বায়ু, জিওথার্মাল, পারমাণবিক শক্তি যেগুলো প্রয়োজনীয় শক্তির একটি বিকল্প, টেকসই এবং পরিচ্ছন্ন উৎস হিসেবে স্বীকৃত। এছাড়া পানির স্রোত (জলবিদ্যুৎ), জোয়ার ভাটা, সমুদ্র তরঙ্গ এবং মহাসাগরের পানির লবণাক্ততা, তাপ ও বিভিন্ন গ্যাসের দ্রাব্যতার ভিন্নতাকে কাজে লাগিয়ে ব্লু এনার্জি বা নীল শক্তি উৎপাদনের সক্ষমতা ও সম্ভাবনা আমাদের দিগন্তে উঁকি দিচ্ছে।
ব্লু এনার্জি বা নীল শক্তি উৎপাদনের উৎস হিসেবে পানির স্রোত, জোয়ার ভাটা, সমুদ্র তরঙ্গ ইত্যাদির ব্যবহার-পদ্ধতি অনেকের কাছে পরিচিত হলেও আরো শক্তিশালী যে পদ্ধতির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত নই সে রকম এক টেকসই শক্তির উৎস যা ক্লিন-এনার্জি প্রযুক্তির পরবর্তী অত্যন্ত সম্ভাবনার জায়গা হতে পারে তাহলো কম লবণাক্ত পানির একটি স্রোত এবং অপেক্ষাকৃত বেশি নোনাজলের একটি স্রোতের নিয়ন্ত্রিত মিশ্রণের সময় নির্গত শক্তি। তাই নদী যেখানে সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হয় সেখানে অফুরন্ত শক্তি নীল শক্তি উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। নদী সমুদ্রের সংযোগে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট জলাশয়ে উৎপাদিত হয় বলে একে নীল” শক্তি বলা হয়।
লবণাক্ততার ভিন্নতাকে কাজে লাগিয়ে নীল শক্তি উৎপাদনের এ প্রক্রিয়ায় মূলত অসমোসিস পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হয়, যা উভয় দিকে ঘনত্ব সমান না হওয়া পর্যন্ত একটি দ্রাবকের অণুর স্বতঃস্ফূর্ত গতিবিধি একটি আধা-ভেদ্য ঝিল্লির মাধ্যমে নিম্ন ঘনত্বের দিক থেকে উচ্চতর ঘনত্বের দিকে যাওয়ার প্রবণতাকে কাজে লাগায় এবং এ প্রক্রিয়ায় যে শক্তি নির্গত হয় তা বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এরই মধ্যে কয়েকটি ল্যাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং কয়েকটি দেশে পরীক্ষামূলক ব্যবহারও শুরু হয়েছে। অসমোসিস পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হয় বলে একে “অসমোটিক শক্তি” বা লবণাক্ততা গ্রেডিয়েন্ট পাওয়ারও বলা হয়।
এ পদ্ধতিতে কী পরিমাণ শক্তি আউটপুট হিসেবে উৎপাদিত হবে তা নির্ভর করে নদী এবং সমুদ্রের জলের লবণাক্ততা ও তাপমাত্রার পার্থক্য এবং নির্দিষ্ট ঝিল্লির বৈশিষ্ট্যের ওপর। লবণাক্ততার পার্থক্য যত বেশি হবে তত বেশি শক্তি উৎপন্ন হবে। বিশ্ব সমুদ্রের গড় লবণাক্ততা এবং নদী নিষ্কাশনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নরওয়ে সেন্টার ফর রিনিউয়েবল এনার্জির করা এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যদি সমস্ত নদীর মোহনায় নীল শক্তির প্লান্ট তৈরি করা হয়, তা থেকে প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার ৩৭০ টেরাওয়াট শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হবে (টেরা মানে ট্রিলিয়ন)।
লবণাক্ততা গ্রেডিয়েন্ট পাওয়ার ব্যবহারের এ নীল শক্তির ধারণা অবশ্য নতুন নয়। ১৯৫৪ সালে আর ই প্যাটল নামে একজন ব্রিটিশ প্রকৌশলী এর বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রথম প্রস্তাব করেছিলন। ১৯৭০ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রস্তাবিত প্যাটলের ধারণা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি, তবে এটি ব্যবহার করার পদ্ধতির রূপরেখা তৈরি হয়েছিল। ফাইনালি ২০০৯ সালে নরওয়ের টফেতে প্রথম অসমোটিক পাওয়ার প্লান্টটি নির্মিত হয়েছিল যেটি থেকে মাত্র চার কিলোওয়াট শক্তি উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল। তবে এর নির্মাণ, পরিচালন এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক বেশি হওয়ায় ২০১৩ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে নীল শক্তিকে ট্যাপ করার উন্নত প্রযুক্তিগুলো আরো উন্নতর করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল নেদারল্যান্ডস এবং নরওয়ের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে। মডিফায়েড ও উন্নতর প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি বাঁধের দুই পাশে জলে লবণের ঘনত্বের পার্থক্য ব্যবহার করে ডাচ্রা ২০১৪ সালে একটি পাওয়ার প্লান্ট তৈরি করেছিল, যা প্রায় ৫০ লাখ বাড়ির প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছিল।
উপরোক্ত নীল শক্তি উৎপাদন শুধু নদী এবং সমুদ্রের জলের মিশ্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, কারণ অসমোসিস দ্রবীভূত পদার্থের যেকোনো ঘনত্বের পার্থক্যকে কাজে লাগাতে সক্ষম। এভাবে দ্রবীভূত কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতে পারে, যা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ও ব্যবহার সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখিয়েছেন। গবেষকরা বিশ্বাস করেন, বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম ব্যবহত জ্বালানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফ্লু গ্যাসগুলোয় প্রায় ৮৫০ টেরাওয়াট নীল শক্তি তৈরি করার মতো যথেষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড রয়েছে। এটাই প্রমাণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ভিলেনই (কার্বন ডাই-অক্সাইড) হতে পারে সংশ্লিষ্ট সমাধানের সর্বোচ্চ অংশীদার।
বিখ্যাত আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির অন্যতম জার্নাল এসিএস ওমেগায় জুলাই ২০১৯-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দাবি করেছেন তারা একটি ব্যাটারি তৈরি করেছেন যা পালো অল্টো আঞ্চলিক বর্জ্য পানি কন্ট্রোল প্লান্ট থেকে সংগ্রহ করা অলবণাক্ত পানি এবং হাফ মুন বে থেকে সংগৃহীত লবণাক্ত পানি ব্যবহার করে উৎপাদিত অসমোটিক শক্তি বা নীল শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। তাদের কাজ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, নীল শক্তি উপকূলীয় বর্জ্য পানি শোধনাগারগুলোকে স্বশক্তিনির্ভর এবং কার্বননিরপেক্ষ করে তুলতে পারে।
নীল শক্তি প্রযুক্তির একটি সুবিধা হলো এটি বায়ু বা সূর্যের মতো বাহ্যিক কারণের ওপর নির্ভর করে না। আরেকটি সুবিধা হলো একটি বাণিজ্যিক শিল্প হিসেবে আকারে ছোট কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শক্তি উৎপাদনে সক্ষম। তদুপরি, বায়ু এবং সৌরশক্তির সঙ্গে তুলনা করলে একটি নীল শক্তি পাওয়ার প্লান্ট বাস্তবায়ন ল্যান্ডস্কেপের খুব ছোট জায়গা ব্যবহার করে। এছাড়া একবার সম্পূর্ণ ও সমন্বিতভাবে স্থাপন করা হলে প্রযুক্তিটি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত না করেই ক্রমাগত শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম। সুতরাং এটি সবার জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, টেকসই এবং পরিচ্ছন্ন শক্তির অ্যাক্সেস নিশ্চিত করবে বলে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা সুপারিশ করছেন।
ব্লু এনার্জি ব্যবহারে যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাহলো পাওয়ার প্লান্টগুলো জলজ কিংবা সামুদ্রিক জীবের জন্য হুমকি হতে পারে এবং নীল শক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের খরচ কয়েকগুণ বেশি হবে কারণ কৃত্রিম ঝিল্লি তৈরি করা খুবই কঠিন এবং ব্যয়বহুল। তবে একবার নির্মিত করে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা অব্যাহত রাখলে আশা করা হচ্ছে যে নীল শক্তি সৌর এবং বায়ুর তুলনায় অনেক সস্তা হারে শক্তি উৎপাদনে সফল হবে।
সমুদ্রের তাপীয় শক্তি রূপান্তর প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ব্লু এনার্জি বা নীল শক্তি উৎপাদন সম্ভব যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যায়। মূলত মহাসাগরের উষ্ণ পৃষ্ঠের পানি এবং ঠাণ্ডা গভীরতার পানির তাপমাত্রার পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে এ শক্তি উৎপাদন করা হয়। এটিও ক্লিন এনার্জি জেনারেশনের একটি অনন্য রূপ যা শক্তির একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং টেকসই উৎস প্রদান করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
পানি এবং শক্তি একে অন্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত। একটি দীর্ঘ প্রযুক্তিগত এবং প্রতীকী সংযোগ ভাগ করে নিয়েছে একে অন্যের সঙ্গে, যার ফলে এক্ষেত্রের গবেষকরা এ সম্পর্ককে শক্তি/পানি নেক্সাস বলে অভিহিত করেছেন। এনার্জি/ওয়াটার নেক্সাস বলতে শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত পানি এবং পানি নিষ্কাশন, পরিশোধন ও সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত শক্তির মধ্যে সম্পর্ককে বোঝানো হয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত PRiME সভায় সারা বিশ্ব থেকে গবেষকরা Energy/Water Nexus: Power from Saline Solutions symposium-এর জন্য সম্ভাব্য কার্যকর প্রযুক্তি এবং কীভাবে পানি এবং শক্তির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কাজ করে এবং ভবিষ্যতে সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করতে একত্রিত হয়েছিল৷ যেখানে তারা একমত হয়েছেন যে পানি ও শক্তি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী আন্তঃসংযুক্ত সিস্টেম। আমরা শক্তি ছাড়া পরিষ্কার পানি পেতে পারি না আবার পানি ছাড়া শক্তি উৎপাদন সম্ভব না।
সুতরাং নীল শক্তি-ই সম্ভাব্যভাবে আমাদের হাতে থাকা সেরা টেকসই শক্তি সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিনামূল্যের কাঁচামাল এবং অশেষ “নীল” এবং “সবুজ” এনার্জির উৎসকে যথাযথ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ব্যবহার করতে পারলে নীল-সবুজের সমন্বয় মিলে যেতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন সংকটের জরুরি সমাধান।
ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন: সমুদ্র শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক, ওশানোগ্রাফি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বণিক বার্তা