২৮
মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় আর ইলিশ উৎপাদনে প্রথম। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের ৭৫ শতাংশই বাংলাদেশে হচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিজ্ঞানী এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে হারে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে তাতে আগামী কয়েক বছরে উৎপাদন আরও বাড়বে। বিশ্বের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ ইলিশ উৎপাদন দেশ হবে বাংলাদেশ। ২০২২ সালে বাংলাদেশ হবে শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী দেশ।মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ আহরণে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চেয়ে ২১ হাজার টন বেশি। গত ১০ বছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তথ্যানুযায়ী ২০০৭-০৮ অর্থবছরের দেশে ইলিশ উৎপাদন ছিল মাত্র ২ লাখ ৯০ হাজার টন। যা এবার ৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে।এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু রোববার দুপুরে যুগান্তরকে বলেন, মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে এক নম্বর মডেল হবে। এ অর্জন শুধুই সম্ভব হয়েছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত চিন্তা-ভাবনার কারণে। তিনি মিৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। তিনি এ খাতে উন্নয়নে জোর দিয়েছেন। তার এমন সাহসী উদ্যোগের কারণেই আমরা আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। আমরা শাকসবজিতেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। আমরা এক সময় শীর্ষে পৌঁছব। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রথম। সমুদ্রে ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ এবং মাছ উৎপাদনে বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে আজ আমরা বিশ্বের মডেল হচ্ছি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ যুগান্তরকে জানান, মাছে-ভাতে বাঙালি- এ স্লোগান আমরা বহু বছর আগ থেকেই শুনে আসছি। এখন আমরা দিন দিন মাছ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে পৌঁছেছি। ইলিশ আমাদের ঐতিহ্য, গর্বের নাম। দেশে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান সরকার মা ইলিশ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধকালীন জেলেদের খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায় ইলিশ উৎপাদন রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২ শতাংশ ইলিশ। এ ছাড়া বর্তমানে দেশের জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখছে ইলিশ। হিসাব অনুযায়ী, বিগত ১০ বছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল মাঠপর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের ফলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। বিগত ২০১৬-১৭ আর্থিক সালে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৪ লাখ ৯৬ হাজার টন। ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সুরক্ষিত হওয়ায় এবং জাটকা ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখার কারণে গত ১০ বছরে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) তথ্যমতে, ইলিশ সারা বছরই কমবেশি ডিম ছাড়ে। তবে প্রধান প্রজনন মৌসুম হচ্ছে আশ্বিন (অক্টোবর) মাস। প্রাথমিক গবেষণা ভিত্তিতে ইতঃপূর্বে আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে ও পরের ১০ দিন, ১১ দিন ও ১৫ দিন মা ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখা হলেও ২০১৬ সালে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে তা ২২ দিন করা হয়েছে- যা ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ আর্থিক সালে ২২ দিন মা ইলিশ সুরক্ষিত হওয়ায় ডিম দেয়া ইলিশের হার ছিল ৪৬.৪৭ ভাগ যা ২০১৭-১৮ সালে হয়েছে ৪৭.৭৪ ভাগ। ফলে ২০১৭-১৮ আর্থিক সালে ৩৬ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে নতুন করে যুক্ত হয়েছে। এ সময়ে ইলিশ ডিম দিয়েছে ৭ লাখ ২৮ হাজার কেজি। অথচ ২০০৮-০৯ সালে যখন ১১ দিন মা ইলিশ আহরণ বন্ধ ছিল, তখন ডিম দেয়া ইলিশের হার ছিল মাত্র ১৭.৬২ ভাগ। বিএফআরআই সূত্রে জানা যায়, একটি ইলিশ ৩ থেকে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠা পানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরবর্তী সময়ে এরা আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫) সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠা পানির দিকে অভিপ্রয়াণ করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে। ইলিশ সারা বছরই কম-বেশি ডিম দেয়। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের ১ম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত ডিম ছাড়ে। এ জন্য চলতি বছরে আশ্বিনের বড় পূণির্মার দিনসহ পূর্বের ১৭ দিন এবং পরের ৪ দিন (১৭+১+৪) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুত ও বিনিময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিএফআরআই সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারা জীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠা পানি ও লোনা পানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ স্রোতের বিপরীতে দৈনিক ৭১ কিলোমিটার অভিপ্রয়াণ করতে পারে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭৫ ভাগ বাংলাদেশ আহরণ করে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, মিয়ানমার এবং ৩য় অবস্থানে ভারত। ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মৎস্য অধিদফতর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল মাঠপর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৮ লাখ টন; ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা হয় ৩.৯৫ লাখ টন। ২০১৬-১৭ সালে তা ৪.৯৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। ২০১৭-১৮ বছরে দেশে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। অর্থাৎ বিগত ৯ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। দেশে ইলিশের ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলে গবেষকরা মনে করছেন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যের ভিত্তিতে গত বছর বরিশাল সদর, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ৮২ কিলোমিটার এলাকাকে ইলিশের ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে অধিক পরিমাণে জাটকা সুরক্ষিত হবে বিধায় চলতি অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়বে বলে গবেষণরা মনে করছেন। ফলে ইলিশ উৎপাদন চলতি অর্থবছর শেষে সাড়ে ৫ লাখ টনে গিয়ে ঠেকবে, এমনটাই সংশ্লিষ্টরা ভাবছেন।
তথ্য সূত্র : যুগান্তর