ফেব্রুয়ারিতেই কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওরে ছিল বোরো ধানের সমারোহ। যেন সোনালি ধানের সাম্রাজ্য! কষ্টার্জিত সেই ধান গোলায় ভরতে সময় লেগে গেল মে মাসের প্রথমদিন পর্যন্ত। এখন গোলাভরা ধানসহ বাড়িঘর গুটিয়ে অন্য গন্তব্যে চলে যাওয়ার পালা! কারণ বৃষ্টি শুরু হলেই হাওর ভরে যাবে থৈ থৈ পানিতে!
বোরো মৌসুমে হাওরে ধানখেতের মাঝখানে চোখে পড়বে অস্থায়ী ‘গ্রাম’ ও ছোট ছোট কুঁড়েঘর। এসব ঘর বানিয়ে বসবাস করেন জিরাতিরা। আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে গাছপালা কিংবা ছায়া নেই। গবাদি পশুর সঙ্গে গাদাগাদি করে গলাঘরে রাত কাটান তারা। এসব মানুষের নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার টয়লেট কিংবা রাতে ঘুমানোর মতো জায়গা।
কিশোরগঞ্জের নিকলী, মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রাম—এ চারটি হাওর উপজেলায় কার্তিক থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে গলাঘরে বসবাস করেন বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৩০ হাজার জিরাতি। এই অস্থায়ী গ্রামগুলোতে প্রায়শই মাত্র কয়েকটি বাঁশের তৈরি ঘর থাকে। এগুলো শুধু শুষ্ক মৌসুমের জন্য তৈরি করা হয় এবং বর্ষায় বন্যার আগে ভেঙে ফেলা হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের ছয় মাস জীবনকে তুচ্ছ করে মাঠে পড়ে থাকেন হাজার হাজার কৃষক।
মোবারক মিয়ার বয়স ৪১ বছর। বর্ষায় তিনি থাকেন নেত্রকোনায়। শুষ্ক মৌসুমে চলে আসেন নিকলী হাওরে। বাড়িতে তিনি গরুর দেখভাল করেন আর তার স্ত্রী তমা বানু হাঁসের ঝাঁক নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাদের এই কর্মযজ্ঞ হচ্ছে বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝখানে তিনটি ঘরকে কেন্দ্র করে; যেখানে তারা বাস করেন।
তাদের বাড়ির বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে, ছোট্ট কুঁড়েঘরে তারা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ঘুমান। মাচার নিচেই রাখা হয় গবাদি পশু। চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বসবাস করা এসব মানুষের ভাগ্যে জোটে না পুষ্টিকর খাবার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মোটা ভাত আর মরিচভর্তা কিংবা পান্তা ভাত দিয়ে চলে খাবার। নেই বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা।
রফিক মিয়া নামের এক কৃষক জানিয়েছেন, প্রতিবছরই ঘরগুলো মূলত নিজস্ব নকশা থেকে নির্মাণ করা হয়। ঘরগুলোতে থাকে টিনের ছাদ, বাঁশের বেড়া। সাথে কিছু আসবাবপত্র ও রান্নার জিনিসপত্রও থাকে। কৃষকরা সেচের জন্য একটি ডিজেল পাম্পসহ প্রয়োজনীয় সমস্ত কৃষি সরঞ্জামও নিয়ে আসেন। এমনকি পুরো মৌসুমের রান্নার জন্য তারা জ্বালানি কাঠ নিয়ে আসেন।
এত কষ্ট, তবুও কেন আসেন?
জিরাতিদের অবস্থা এখন আগের মতো নেই। অভাব-অনটনে অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছেন তারা। গত ৩ বছর ধরে বোরো ধান ঘরে তুলতে পারলেও এর পূর্বে কয়েকবার হাওর ডুবির কারণে অনেক জিরাতি এখন আর এখানে আসেন না। প্রবীণ জিরাতি সুধন্য মল্লিক বলেন, ‘বাপ-দাদার জমি ছাইড়া যাইতে মন চায় না। তাই প্রতিবছর এমন সময়ে এখানে আসি। জিরাত করে যাই পাই তাই লইয়া বাড়িতে যাই।’
দুঃখ-কষ্ট ভোলেন ভালো ফলনে
প্রাকৃতিক কাজ সারতে হয় খেতের আলে। আছে শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাতসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা। তবে এ সবকিছু তুচ্ছ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কৃষকরা বছরের ছয়টি মাস পড়ে থাকেন হাওরে। নিজেদের ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন ফেলে কার্তিক মাসে তারা পাড়ি জমান হাওরে। জমি তৈরি করা, চারা রোপণ, সেচ, পরিচর্যা থেকে শুরু করে ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই শেষে নতুন ধান সঙ্গে নিয়ে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বাড়ি ফেরেন জিরাতিরা।
ভালো ফলন হলে একর প্রতি ৮০ থেকে ৯০ মণ ধান পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে উৎপাদিত শস্যগুলো তারা কিশোরগঞ্জে নিজ বাড়িতে নিয়ে তারপর বাজারে বিক্রি করবেন। ফলন ভালো হলে তাদের মুখে হাসি ফোটে। ভুলে যান পেছনের দুঃখ-কষ্ট। আবারও প্রস্তুতি নেন পরের বার হাওরে যাওয়ার।
বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এভাবেই চলছে জিরাতিদের জীবনচক্র! বাপ-দাদা থেকে শুরু করে তাদেরও আগের বংশধররা এভাবেই চালাচ্ছেন নিজেদের কৃষিকাজ। কিন্তু নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এই খাদ্য সৈনিকদের খবর নেয় না কেউ। তাদের জিরাতিকালে জীবনমান উন্নয়ন কিংবা সামান্য পানীয়জল আর স্যানিটেশন নিশ্চিত করা হলে দেশের জন্য তারা আরো বেশি অবদান রাখতে পারবেন।