বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় একের পর এক রিসোর্ট গড়ে উঠছে। বনের গাছ কেটে, খাল ভরাট করে খুলনা ও সাতক্ষীরায় ১৪টি রিসোর্ট (অবকাশকেন্দ্র) গড়ে তোলা হয়েছে। আরও আটটির নির্মাণকাজ চলছে। রিসোর্টগুলো চালানোর জন্য বিকট শব্দে চলছে জেনারেটর। বাজছে সাউন্ড সিস্টেম বা শব্দযন্ত্র। বেশির ভাগ রিসোর্টে স্থাপন করা হয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছে। এসব এলাকায় সেখানকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষতি করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ কিংবা কোনো কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা এসব রিসোর্ট বনের পরিবেশের ক্ষতি করছে। রিসোর্টগুলোর আশপাশে পানি, শব্দ ও মাটিদূষণ বাড়ছে। বনের প্রাণীরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
চার গুণ বেড়েছে রিসোর্ট
২০১৮ সালে খুলনার দাকোপ ও বাগেরহাটের মোংলা এলাকায় সুন্দরবন ঘিরে ইকো কটেজের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩। ২০২১ সালেও তা একই ছিল। এরপর যেন রিসোর্ট নির্মাণের হিড়িক পড়ে। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক সুন্দরবন ঘিরে কমিউনিটি-বেজড ইকোট্যুরিজম নিয়ে বেজলাইন স্টাডি করেছেন।
ওই গবেষণার তথ্য বলছে, দুই বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালে এসে রিসোর্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২। ২০২৩ সালে ১২টি রিসোর্টের ৭৪টি কক্ষে পর্যটক থাকতে পারতেন ২৬০ জন। চলতি বছর আরও ৫৮ কক্ষবিশিষ্ট ৮টি কটেজ তৈরি হচ্ছে। সাতটি পুরোনো কটেজে নতুন ৪২টি কক্ষ তৈরির কাজ চলছে। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ২০টি কটেজে পর্যটক ধারণক্ষমতা দাঁড়াবে ৫৬০ জনে।
জানতে চাইলে খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের ইসিএ নীতিমালা অনুযায়ী সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে পরিবেশের ক্ষতি করে, এমন কোনো স্থাপনা করা যাবে না। ওই নীতিমালা না মেনে কটেজগুলো তৈরি হয়েছে। এতে পরিবেশ ও সুন্দরবনের ক্ষতি হচ্ছে। সব পক্ষকে নিয়ে কী করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে এ পর্যন্ত দুটি রিসোর্ট তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে দোতলা ভবনসহ কয়েক একর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে বরসা রিসোর্ট। বরসা নামে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ওই রিসোর্টটির মালিক; ২০১১ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। সেখানে নিজস্ব মিলনায়তন, পার্কিং ব্যবস্থা, জেনারেটর, শীতাতাপনিয়ন্ত্রণ কক্ষ, নিজস্ব জেটি, স্পিডবোটসহ নানা কিছু রয়েছে।
রিসোর্টটির ব্যবস্থাপক মো. আমানুল্লাহ বলেন, এসি কিংবা জেনারেটর ব্যবহার করায় ক্ষতি হচ্ছে বলে তাঁর মনে হয় না।
শ্যামনগরের সুন্দরবনসংলগ্ন মুন্সিগঞ্জে একই ধরনের ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো নিয়ে গড়ে উঠেছে টাইগার পয়েন্ট নামের একটি রিসোর্ট। এটির মালিকানা সাতক্ষীরাকেন্দ্রিক এনজিও সুশীলনের। ২০০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সুশীলনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নূরুজ্জামানও মনে করেন এসি বা জেনারেটর চালানোর জন্য পরিবেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।
নদীর মধ্যে ঢুকেছে কটেজ
গত কয়েক বছরে মোংলা, দাকোপের ঢাংমারী ও শ্যামনগর এলাকায় একেবারে সুন্দরবন ঘেঁষে কিছু কটেজ গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি ঢাংমারীতে।
গত ১ মে পশ্চিম ঢাংমারী ও কৈলাসগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ৫০ মিটারের মতো প্রশস্ত ঢাংমারী নদীর এক পারে গ্রাম, অন্য পারে সুন্দরবন। প্রতিটি রিসোর্টে নদীর পাড়ে রয়েছে বড় ঘাটলা। সেখান থেকে সিঁড়ি নেমেছে নদীর মধ্যে।
যেতে যেতে দেখা গেল, প্রায় তিন কিলোমিটারের মধ্যে সাতটি কটেজের কাজ চলছে। নদীর লোকালয়ের পাড় ঘেঁষে একটি বড় জায়গাজুড়ে গাছ ও কাঠ দিয়ে হাঁটার পথ তৈরির পাশাপাশি চলছে ঘর নির্মাণের কাজ। ‘জঙ্গলবাড়ি’ নামের একটি ইকো কটেজ নির্মাণের কাজ শেষের দিকে। ‘গোলকানন’ নামের একটি রিসোর্টের পাশে অন্য একটি রিসোর্টের কাজও শেষের দিকে। এটি নির্মাণে বালু দিয়ে জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কটেজের রান্নার জায়গাসহ কিছু স্থাপনা বেড়িবাঁধের ভেতরের অংশে রাখা হয়েছে। মাটিতে বড় গর্ত করে আলাদাভাবে পচনশীল ও অপচনশীল বস্তু রাখা হচ্ছে। প্লাস্টিকের মতো বর্জ্য কয়েক দিন পরপর ফাঁকা জায়গায় পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কটেজে পর্যটক আসার হিসাব থেকে দেখা যায়, ২০১৮ সালে পর্যটক এসেছিলেন ৩৭০ জন। ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৫৬২ জনে।
সম্প্রতি কটেজের মালিকেরা ‘সুন্দরবন রিসোর্ট মালিক সমিতি’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছেন। ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ইমনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব যে ঠিকভাবে মেনে চলতে পারছি, এমনটা না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অন্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আমরা চাই একটি নীতিমালা হোক। আমরা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি চাই না।’
নামেই ইকো কটেজ
কটেজগুলোকে ‘কমিউনিটি-বেজড ইকো কটেজ’ বলা হলেও স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততা বেশ কম। ইকো কটেজের যেসব ধারণা, সব কটেজে তা নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাছগাছালির মধ্যে এসব কটেজ তৈরির জন্য কিছু বড় গাছ কাটা পড়ছে। প্রাকৃতিক জলাভূমিও নষ্ট করা হয়েছে। একাধিক রিসোর্টে হাঁটার পথ, শৌচাগার, এমনকি ঘরেও কংক্রিটের ব্যবহার চোখে পড়েছে। রিসোর্ট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীতে পর্যটক আনা-নেওয়ার জন্য ট্রলারের সংখ্যাও বেড়েছে, যা বনের নীরবতা ভাঙছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কটেজগুলোয় শব্দযন্ত্রের ব্যবহার, তীব্র আলো, জেনারেটর ব্যবহার, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। কয়েকটি কটেজের অভ্যন্তরীণ সজ্জা দেখে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া বিজ্ঞাপন থেকে জেনারেটর ও এসি ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ঢাংমারীর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য দিলীপ কুমার মণ্ডল বলেন, কটেজগুলোর মালিক বাইরের মানুষ। তবে কটেজ হওয়ায় জমির দাম বেড়েছে। মানুষের কিছু কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এলাকার হাঁস-মুরগি, সবজি তাঁরা কিনছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে ১৫-২০ বছরের জন্য জমি ইজারা নিয়ে এসব কটেজ করা হয়। ট্রেড লাইসেন্স আর ইজারার দলিল হলেই ব্যবসা শুরু হয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি বাদে সব কটি রিসোর্ট যৌথ মালিকানায় গড়ে উঠেছে। মালিকদের বেশির ভাগই পর্যটন-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের সেন্ট মার্টিন, সাজেক, শ্রীমঙ্গলে রিসোর্ট ব্যবসা আছে। হাওরে হাউসবোটও আছে।
নির্মাণাধীন জঙ্গলবাড়ি ইকো রিসোর্টের মালিকানায় আছেন পাঁচটি ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল গ্রুপের মালিকেরা। তাঁদের একজন জাকারিয়া শাওন প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনে রিসোর্ট করার ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই পর্যটন ব্যবসায়ীদের ছিল। মূলত এখানকার প্রথম দিকের কিছু রিসোর্টের সফলতা দেখেই অন্যরাও আসছেন। পরিবেশের কোনো ক্ষতি হোক, তাঁরাও সেটা চান না।
পশ্চিম ঢাংমারী গ্রামের প্রথম ইকো রিসোর্ট গোলকানন। একটি বেসরকারি সংস্থা স্থানীয় বনজীবীদের বনের ওপর নির্ভরতা কমাতে ওই রিসোর্ট তৈরি করে দেয়। এর আয় যায় স্থানীয় বনজীবী আটটি পরিবারে। রিসোর্টের তত্ত্বাবধায়ক শ্রীপতি বাছাড় প্রথম আলোকে বলেন, ‘কটেজ করতে যে পুঁজির দরকার হয়, এখানকার গরিব মানুষের পক্ষে সেই টাকা বের করা কষ্টকর। এখন যেসব রিসোর্ট হচ্ছে, এগুলোর মালিক বাইরের। তাঁদের এখানে কাজের মানুষের দরকার হয়। গ্রামের লোকজন হয়তো সেই কাজগুলো করছে।’
‘বনের জন্য শুভ নয়’
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাসের মহসিন হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কটেজগুলো বনের জমির মধ্যে না হলেও সেগুলোর প্রধান উপজীব্য বন। কটেজের দূষণ বনের ওপর প্রভাব ফেলবে। এর বাইরে মালিকেরা বন বিভাগের অনুমতি না নিয়ে পর্যটকদের বনের মধ্যে নিয়ে যান। ফলে পর্যটকেরা বনে গিয়ে কোনো ক্ষতি করছেন কি না, সেটা দেখার সুযোগ থাকছে না। এ ব্যাপারে দ্রুত একটা নীতিমালা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এভাবে রিসোর্ট নির্মাণ বনের জন্য শুভ নয় বলে মনে করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বনের সার্বিক পরিবেশের ওপর এটা বিরূপ প্রভাব ফেলে। একদিকে ইসিএ এলাকা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে একদমই বাণিজ্যিক ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে এই বনের পেরিফেরিতে বন্য প্রাণীর যে রকম চলাফেরা ছিল, নিশ্চয়ই এখন সেভাবে নেই।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কল্যাণ ব্যানার্জী, সাতক্ষীরা]