সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুগ্ধ উৎপাদনকেই বাণিজ্যিকভাবে নিয়েছেন রাজশাহী অঞ্চলের খামারিরা। রাজশাহী শহরেই পাড়া-মহল্লা ও পদ্মার কোল ঘেষা চরে গড়ে উঠেছে দুধের খামার। দিনে দিনে দুধের উৎপাদন ও চাহিদা চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এমন উদ্যোগ দেখে অনেকেই এগিয়ে আসছে দুগ্ধ উৎপাদন খামারে ।
রাজশাহী শহরেই প্রাচীনকাল থেকে দুধের জন্য বংশ পরমপরায় নগরীর ঘোষপাড়া কুমারপাড়া, লক্ষীপুর ঘোষপাড়া ও সিপাইপাড়া ঘোষপাড়া বিখ্যাত। এই পাড়াগুলোতে প্রায় দুই শতাধিক ঘোষ পারিবার দুধের ব্যবসার সঙ্গে দির্ঘদিন ধরে জড়িত। এখানে পায় দুই শতাধিক গরু দুধ উৎপাদন করে এলাকাবাসীর চাহিদা পূরণ করছে। এছাড়া নগরীর চকপাড়া, মেহেরচন্ডী, বুধপাড়া, টিকাপাড়াসহ আরো অনেক স্থানে বাক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে দুধের একাধিক খামার । এই খামারগুলোতে বাড়ছে দুধের উৎপাদন। বিশেষ করে চর ও গ্রাম পর্যায়ে দুধের উৎপাদন বেড়েছে। ফলে রাজশাহী এখন দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
নগরীর কুমারপাড়া ঘোষ পাড়ার পলাশ ঘোষ জানান, আমাদের পারিবারিকভাবে এই ব্যবসা। আমার ৬টি গরু থেকে প্রতিদিন ৪০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। সেই দুধের কিছুটা নিজেদের খাবার জন্য রেখে বাকি সব দুধই বিক্রি করে দেই। পলাশ ঘোষ আরো জানান, ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পূরণ করতে পারি না, শহরের আশপাশ থেকেও দুধ সংগ্রহ করে ক্রেতার চাহিদা মিটাই। এই দুধ বিক্রি হয় ৮০ টাকা লিটার দরে। এই ঘোষপাড়াতে কুড়ান ঘোষ এর ২০টি গরু, বাদল ঘোষ এর ৫টি, প্রদিপ ঘোষ এর ৭টিসহ আরো ঘোষপারিবারে প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে গরু প্রতিপালন করে ব্যবসা করে আসছে। এখান থেকেই এলাকার ২০০টি বাড়িতে এবং চা ও মিষ্টির দোকানে যায় দুধ। এছাড়া সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত খামারে এসে দুধ নিয়ে যায় ক্রেতারা।
এদিকে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে ধু-ধু বালুচর। প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে নদীর মধ্যেই জেগেছে চর। চরের কিনারে হাজার হাজার গবাদিপশুর অস্থায়ী আশ্রয়স্থল, যা ‘বাথান’ নামে পরিচিত।
পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের চরখিদিরপুরের ১০ নম্বর বা মিডল চর চরগুলোর একটি। এই চরে তিনটি বাথানে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গরু, মহিষ ও ভেড়া রয়েছে।
রাখালরা জানান, দুধের দাম আগের চেয়ে বাড়ছে। এজন্য চরে গরুর দুধ উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকরা।
চরে একটি বাথানের মালিক শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, “এখানে কারও কারও ৫০-১০০টি গরু রয়েছে। যার ১০০টি রয়েছে। লাভের কারণেই এত চ্যালেঞ্জ নিয়ে গরুর মালিকরা বাথানে গরু রাখেন। এখন দুধের চাহিদা অনেক বেশি। ফলে ষাঁড়ের তুলনায় গাভি পালনে আগ্রহী স্থানীয়রা।”
চরের ঘোষ (গোয়ালা) নিরাময় দাস বলেন, প্রতিদিন এখান থেকে অন্তত ২০০-২৫০ কেজি দুধ নিয়ে যাই। এখান থেকে দুধ পরিবহন কষ্ট হলেও আসি। কেননা গরুগুলো মাঠের ঘাস খায়। এজন্য এর চাহিদাও বেশি।
আরেকটি বাথানের মালিক মো. বাচ্চু বলেন, হাজার হাজার গরুর খাবার প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা অনেক কষ্টকর। তারপরও গরুর সংখ্যা বেড়েছে। দুধও বেড়েছে। আগে এই চরে সবমিলিয়ে ২০০ গরু দুধ দিতো। এখন সেটি বেড়ে ৩৫০-৫০০ গরু হয়েছে।
তবে তিনি বলেন, গরুর দুধ উৎপাদন বাড়লেও আমরা ন্যায্য দাম পাই না। কেননা আমাদের নদী পার হতে হয়। এতেই খরচ বেড়ে যায়।
রাজশাহী বাঘা এলাকার খামারি এনামুল হক বলেন, ‘আগে দুটি গরু পালতাম (পালন করতাম)। পরে ষাঁড়ের পাশাপাশি গাভীও পালা শুরু করি। গত দুই বছরে নতুন করে চারটি গাভী কিনেছি। গাভীগুলো প্রতিদিন ২৫ কেজি দুধ দিচ্ছে। দামও ভালোই পাচ্ছি।’
এদিকে জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজশাহীতে দুধের চাহিদা ৫ দশমিক ৮ লাখ টন। গতবছর দুধ উৎপাদন হয়েছে ৫ দশমিক ৫ লাখ টন। চলতি বছরে সেই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮ লাখ টন। দুধ উৎপাদনকারী গরুর সংখ্যা রয়েছে প্রায় তিন লাখ।
কথা হয় জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজশাহীতে যথেষ্ট পরিমানে মাংস ও দুধ উৎপাদন হয়। এই জেলা দুধ ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশেষ করে দুধের উৎপাদন বাড়ছে। গতবারের চেয়ে এবার উৎপাদন বেড়েছে উদ্যোক্তাও বেড়েছে ।
সূত্র: সংবাদ।