হাতে লাঠি, মুখ কাপড়ে ঢাকা। সবাই চোরাকারবারি। কোরবানি সামনে রেখে তাদের যেন আগেই লেগেছে ‘ঈদ’। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তের কালাচাইন্দায় রাতের আলো-আঁধারিতে সীমান্ত গলে গরুর পাল ঢুকছে বাংলাদেশে। রাত যত গভীর হয়, ততই নামে গরুর ঢল। সীমান্ত ডিঙিয়ে কিছুদূর এগোতেই প্রস্তুত ট্রাক। সেই ট্রাকে দলে দলে সওয়ার হচ্ছে গরু। এরপর চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। এভাবেই কাঁটাতার, নদী আর পাহাড়– সবকিছু একাকার করে ভিনদেশি গরু মিশে যাচ্ছে কোরবানির হাটে। স্থানীয় রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী ও প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি জড়িত থাকায় চোরাচালান চক্রটি বেশ শক্তপোক্ত, অপ্রতিরোধ্য। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এ-প্রান্তে গরু আনতে ঘাটে ঘাটে দিতে হচ্ছে বখরা। আবার সীমান্তরক্ষীর চোখ এড়াতেও চলছে নানা কিসিমের কেরামতি।
শুধু বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি নয়, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন সীমান্তে চোরাই পথে গরু আনছে বড় একটি চক্র। এতে সরকার হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব। সমকালের সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা সীমান্ত এলাকা ঘুরে এমনই তথ্য পেয়েছেন।
এদিকে, কোরবানির সময় ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আসবে না– সরকারের এমন ঘোষণায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন খামারিরা। এখন সীমান্ত দিয়ে দেদার গরু ঢোকায় লোকসানের শঙ্কায় নিরাশ তারা। যদিও প্রশাসনের দাবি, ভারত ও মিয়ানমার থেকে গবাদি পশুর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নেওয়া হয়েছে কঠোর ব্যবস্থা।
মাসখানেক ধরে চলা গরু পাচারের কারণে সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন খামারের পশুর শরীরে নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ খামারিদের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে বৈধ পথে পশু আনতে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অথচ চোরাই পথে আসা গরুর শরীরে রোগ আছে কিনা, তা জানার সুযোগ নেই। এতে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। দেশজুড়ে অজানা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। চোরাই পথে আসা পশু মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবু চোরাই পথ খোলা
২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে বাড়ে গবাদি পশু পালন। দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ২০ লাখ খামার আছে। এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭; যা চাহিদার চেয়ে প্রায় ২৩ লাখ বেশি। এ সংখ্যা গত বছরের চেয়েও ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি বেশি। কয়েক বছর ধরে কোরবানি ঈদের আগে সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় আসেনি পশু। তবে এবার সীমান্ত অনেকটাই ঢিলেঢালা।
কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া; বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি; সিলেট, কুমিল্লা, লালমনিরহাটসহ ছয় জেলার ৩৮ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সবচেয়ে বেশি পশু ঢুকেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
একদিকে পশুখাদ্যের উচ্চমূল্য, তীব্র তাপদাহে বাড়তি যত্নের জন্য বেশি উৎপাদন খরচ এবং ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে এমনিতেই খামারির ত্রাহি অবস্থা। তার পরও চোরাই পথে অবাধে গরু ঢোকায় পথে বসার উপক্রম খামারিদের। তাদের অভিযোগ, ২০১৪ সালের নিষেধাজ্ঞার পর এবারের মতো এত ‘খোলামেলা’ সীমান্ত কখনও দেখা যায়নি।
যেভাবে সীমান্ত পার
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গরু সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুই ধরনের লোককে কাজে নামায় চোরাকারবারি চক্র। একটি গ্রুপ গরুর সঙ্গেই থাকে; আরেকটি গ্রুপ রাস্তায় পুলিশ, বিএসএফ, বিজিবি থাকে কিনা, তা জেনে কারবারিকে খবর দেয়। তারা গরুপ্রতি দুই হাজার টাকা করে পায়। সীমান্ত পার হওয়ার পর দেশের কোনো হাট থেকে টাকার বিনিময়ে গরু কেনার নকল কাগজপত্র তৈরি করে নেওয়া হয়। এতে পথে আর পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয় না।
গরু ঢোকাতে ১৪ ‘নাটের গুরু’
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ভালোবাসা, কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি এবং রামুর হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটা দিয়েও চোরাই পথে মিয়ানমারের গরু আসছে। সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, চিহ্নিত ১৪ ব্যক্তির নেতৃত্বে দুই শতাধিক চোরাকারবারি কোরবানির ঈদ ঘিরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ট্রাকযোগে এসব গরু পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, ডাকাত ও ব্যবসায়ী এ চোরাচালানে জড়িত। তাদের মধ্যে রয়েছেন কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নজরুল ইসলাম, শাহজাহান সিরাজ শাকিল, যুবলীগ নেতা নাছির উদ্দিন সোহেল, গর্জনিয়া বাজার সমিতির সভাপতি এরশাদ উল্লাহ, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াছিন আরাফাত রিশাদ, যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম, যুবদল নেতা আনোয়ার ইসলাম রাশেল, শওকত, নজরুল, ছাত্রলীগ নেতা ইমাদ সিকদার, শাকিল আদনান ও তারেক উদ্দিন মিশুক।
এদিকে, মিয়ানমার থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর হয়ে রামু ঈদগাহ বাজারের প্রভাবশালী রমজানুল আলমের গরুর আড়তে এনে ট্রাক ভর্তি করে মহাসড়ক দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হচ্ছে গরু। পাচারের সঙ্গে নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ইমন জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের খামারি আবদুর রশীদ বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত হাটে তোলা বেশির ভাগ পশুই ভিনদেশি। মিয়ানমারের গরু রোগা। এ কারণে ওই সব গরুর দাম কম।
জনপ্রতিনিধির হাতে নাটাই
সিলেট সীমান্তের চার উপজেলার ১৮ পয়েন্ট দিয়ে গভীর রাতে ভারত থেকে গরু ও মহিষ নিয়ে আসে চোরাকারবারিরা। পরে স্থানীয় বাজারের ইজারাদারের কাছ থেকে রসিদ নিয়ে গরু ‘হালাল’ করা হয়। সবচেয়ে বেশি ভারতীয় পশু নিয়ে আসা হয় গোয়াইনঘাটের দমদমা সীমান্ত, বিছনাকান্দি, মরকিটিলা, লক্ষ্মণছড়া, পান্তুমাই, প্রতাবপুর, লামাপুঞ্জি খাসিয়া হাওর সীমান্ত এলাকা দিয়ে। উপজেলার রাধানগর বাজারের ব্যবসায়ী ইসলাম উদ্দিন, জাফলংয়ের খোকন মিয়াসহ পাঁচ থেকে সাতজন এ অপকর্মে জড়িত।
জৈন্তাপুরের মিনাটিলা, আলুবাগান, লালাখাল, টিবির হাওর সীমান্ত এলাকা দিয়ে গরু ও মহিষ নিয়ে আসা হয়। উপজেলার হরিপুর বাজারের ব্যবসায়ীরা তা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের মধ্যে ফতেহপুর ইউপি চেয়ারম্যান রফিক আহমদ, সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক জাকারিয়া মাহমুদ, তাঁর ভাই ইয়াহইয়া মাহমুদসহ কয়েকজন জড়িত। জৈন্তাপুরের হরিপুর, চিকনাগুল, দরবস্তসহ কয়েকটি বাজারে চোরাচালানের পশু বিক্রি করা হয়। কানাইঘাট সীমান্তে পশু চোরাচালানে লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তমিজ উদ্দিন ও দিঘিরপাড় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার শাহাব উদ্দিনসহ কয়েকজন জড়িত। আরেক উপজেলা কোম্পানীগঞ্জের উত্তর রনীখাই ইউনিয়নের তুরং সীমান্ত এলাকা দিয়ে গরু-মহিষ আসে।
কুমিল্লা সীমান্তে ৫ পয়েন্ট
কুমিল্লা সীমান্তের ১০৬ কিলোমিটার অংশের পাঁচ পয়েন্ট দিয়ে চোরাকারবারিরা গরু আনছে। জানা যায়, কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বিবিরবাজার ও সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার আশাবাড়ী, বুড়িচং উপজেলার ভবেরমুড়া, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ডিমাতলী এলাকাকে গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট হিসেবে বেছে নিয়েছে চোরাকারবারিরা। কুমিল্লা অঞ্চলে মাহবুব নামে এক ব্যাপারী প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০টি গরু হাতবদল করেন সীমান্ত এলাকায়। তিনি কক্সবাজারের উখিয়ার একটি চক্রের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা ইউনিয়নের শিপন ও রুহুল আমিন নামের আরও দুই চোরকারবারি গলিয়ারা সীমান্ত দিয়ে কোরবানি সামনে রেখে গরু আনছেন। অভিযোগ রয়েছে, মাহবুব ও শিপনের মতো জেলাজুড়ে আরও কয়েকজন চোরাকারবারি পশু আনার কাজে সক্রিয়।
ব্রাহ্মণপাড়ার আশাবাড়ী সীমান্ত এলাকার খামারি শফিক মিয়া বলেন, ‘চোখের সামনে দিয়ে রাতের বেলা আমগো এদিক দিয়া গরু নামতেছে। তারগো হাত শক্তিশালী। চোরাই গরু এনে আমাদের স্বপ্ন চুরমার করা হচ্ছে।’
কারা কী বলছেন
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ৫৫ হাজার খামারি আমাদের সংগঠনের সদস্য। অনেক দিন ধরে আমাদের সদস্যরা তথ্য দিয়ে বলছেন, বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার গরু ঢুকছে। হঠাৎ করে উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন এলাকায় দেশি গরুতে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। লাম্পি স্কিন (এলএসডি) রোগে হাজার হাজার গরু আক্রান্ত হচ্ছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেন, রাতের অন্ধকারে কিছু গরু ঢুকছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়েছে। রাষ্ট্র কোনোভাবেই কোরবানির জন্য কাউকে পশু আমদানি করার অনুমতি বা বৈধতা দেয়নি। প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সিলেট ব্যুরোর মুকিত রহমানী, কক্সবাজার প্রতিনিধি ইব্রাহিম খলিল মামুন, কুমিল্লা প্রতিনিধি মো. কামাল উদ্দিন, চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি মাহমুদুর রহমান মাহমুদ]