কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিদের দ্বিতীয়বারের মতো সম্মাননা দিচ্ছে সরকার। পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ২২ জনকে ২০২১ সালের জন্য ‘কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এগ্রিকালচারাল ইম্পর্ট্যান্ট পারসন- এআইপি)’ সম্মাননা দেবে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় এসিআই লিমিটেডের কর্ণধার এ কে এম ফারায়েজুল হক আনসারী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজসহ ২২ জন ব্যক্তিকে এআইপি হিসেবে মনোনীত করে আদেশ জারি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সোমবার (২৪ জুন) তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। ‘কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নীতিমালা, ২০১৯’ অনুযায়ী এ সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে।
এআইপি নির্বাচনের জন্য সুপারিশ দিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। সেই কমিটির সুপারিশের পর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে নির্বাচিতদের তালিকা প্রকাশ করা হয়।
সিআইপি’র (বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) মতো স্বীকৃতি দিতে ২০২০ সাল থেকে কৃষিক্ষেত্রে এআইপি সম্মাননা দিচ্ছে সরকার। ২০২০ সালের সম্মাননা ২০২২ সালে দেওয়া হয়। প্রথমবার ১৩ জনকে এআইপি সম্মাননা দেওয়া হয়
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মলয় চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, দ্বিতীয়বারের মতো কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এআইপি সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। এবার পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ২২ জন এ সম্মাননা পাচ্ছেন। আগামী ৭ জুলাই ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মনোনীতদের হাতে এআইপি কার্ড তুলে দেওয়া হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী ‘কৃষি (উদ্ভাবন জাত/প্রযুক্তি)’ ক্যাটাগরিতে ৪ জন, ‘কৃষি উৎপাদন/বাণিজ্যিক খামার স্থাপন ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প’ ক্যাটাগরিতে ১০ জন, ‘রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্য উৎপাদন’ ক্যাটাগরিতে ২ জন, ‘স্বীকৃত বা সরকার কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত কৃষি (ফসল/ মৎস্য/প্রাণিসম্পদ/বনজসম্পদ উপখাতভুক্ত) সংগঠন’ ক্যাটাগরিতে ৩ জন এবং ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কারে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত’ ক্যাটাগরিতে ৩ জন এআইপি নির্বাচিত হয়েছেন।
কৃষি (উদ্ভাবন জাত/প্রযুক্তি)
এ ক্যাটাগরিতে সম্মাননার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন এসিআই লিমিটেডের কর্ণধার এ কে এম ফারায়েজুল হক আনসারী। তিনি এসিআই লিমিটেডের কর্ণধার হিসেবে ৩৫ বছর ধরে কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা এবং সম্প্রসারণে অবদান রেখেছেন। এসিআই লিমিটেড ১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম দেশে হাইব্রিড ধানের প্রবর্তন করে। এ পর্যন্ত তাদের নিজস্ব গবেষণালব্ধ ১৩টি হাইব্রিড ধানের জাত বাজারজাত করেছে বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নিয়ে গবেষণার কারণে এ ক্যাটাগরিতে সম্মাননা পাচ্ছেন চুয়াডাঙ্গার জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ওলি উল্লাহ। তিনি সরকারি এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থেকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি ও সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
কৃষি উৎপাদন/বাণিজ্যিক খামার স্থাপন ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প
টাঙ্গাইল মধুপুরের কৃষি উদ্যোক্তা মো. ছানোয়ার হোসেন এ ক্যাটাগরিতে মনোনীত হয়েছেন। তিনি কৃষি বিভাগের পরামর্শে উন্নত জাতের জাম্বুরা, আনারস, পেয়ারা, ড্রাগন, সৌদি খেজুর, ভিয়েতনামী খাটো জাতের নারকেল, মিশরীয় ডুমুর ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থকরী ফসলের বাগান গড়ে তুলেছেন। তার উৎপাদিত ফসল দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হয়।
ফরিদপুরের পেঁয়াজ ও পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনকারী উদ্যোক্তা শাহীদা বেগম সম্মাননা পাচ্ছেন। তিনি ২০২০-২১ অর্থবছরে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করে মোট এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা আয় করেন। তিনি খাঁন বীজ ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী।
পেঁয়াজ ও পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনকারী উদ্যোক্তা শাহীদা বেগম সম্মাননা পাচ্ছেন। তিনি ২০২০-২১ অর্থবছরে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করে মোট এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা আয় করেন। তিনি খাঁন বীজ ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী
চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের গ্রিন প্ল্যানেট এগ্রোর মালিক মো. রুহুল আমিন এআইপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আধুনিক পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি, ড্রাগন, পেয়ারা, মাল্টার বাগান করে একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার সৃজিত বাগানে বেকার যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ রায়গঞ্জের মো. সাখাওয়াত হোসেন এআইপি মনোনীত হয়েছেন। তিনি অ্যাগ্রো বেইজড সোসিও ইকোনোমিক্যাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেসের চেয়ারম্যান। সাখাওয়াত হোসেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষি উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলাধীন বিস্তীর্ণ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের মাধ্যমে অনাবাদি জমিকে তিন ফসলি আবাদি জমিতে পরিণত করেছেন।
নোয়াখালী বেগমগঞ্জের মাছুদুল হক চৌধুরী কৃষি উৎপাদন, বাণিজ্যিক মৎস্য খামার ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় এআইপি সম্মাননা পাচ্ছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারও পেয়েছেন।
সিলেট ফেঞ্জুগঞ্জের আরেক সফল কৃষি উদ্যোক্তা মো. সিরাজুল ইসলাম রেখন সম্মাননা পাচ্ছেন। তিনি বাণিজ্যিকভাবে মাল্টা, থাই পেয়ারা, আম, কাঁঠাল, লিচু, কমলা, সফেদা, কুল বরই, সবজি ইত্যাদি অর্থকারী ফসল চাষ করে ২০২১ অর্থবছরে এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা আয় করেছেন।
এছাড়া শেরপুরের মো. হযরত আলী ফল চাষ করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা আয় করেছেন। তিনিও এআইপি নির্বাচিত হয়েছেন।
রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদন
‘রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদন’ ক্যাটাগরিতে এআইপি সম্মাননা পাচ্ছেন গাজীপুর সদরের বনসাই শিল্পী কে এম সবুজ। তিনি লিভিং আর্ট গার্ডেন-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। সবুজ বাণিজ্যিকভাবে বনসাই নার্সারি গড়ে তুলেছেন এবং বনসাই রপ্তানি করেন। তিনি বৃক্ষরোপণ জাতীয় পুরস্কার এবং সার্ক কালচারাল সোসাইটি থেকে বিশেষ সম্মাননা পেয়েছেন।
এ ক্যাটাগরিতে আরও নির্বাচিত হয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের কৃষি উদ্যোক্তা মোহা. রফিকুল ইসলাম। তিনি বছরব্যাপী বারোমাসি আম উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ২০২১ সালে তার খামার থেকে আয় ছিল প্রায় তিন কোটি ৭৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।
স্বীকৃত বা সরকার কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত কৃষি (ফসল/ মৎস্য/প্রাণিসম্পদ/বনজসম্পদ উপখাতভুক্ত) সংগঠন
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চ্যানেল আই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাইখ সিরাজ এ ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় তিনি এ সম্মাননা পাচ্ছেন।
সম্মাননা পাচ্ছেন চট্টগ্রামের পরিবেশ বিষয়ক সংগঠক সাহেলা আবেদীন (রিমা)। তিনি সংগঠন ‘তিলোত্তমা চট্টগ্রাম’ এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ২০০ ছাদ বাগান স্থাপন করেছেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি অফিসের পরিত্যক্ত স্থানে প্রায় ৩ লাখের বেশি ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপন করেছেন।
এ ক্যাটাগরিতে আরও পুরস্কার পাচ্ছেন সাতক্ষীরা কলারোয়ার একজন সফল নারী কৃষি উদ্যোক্তা শিখা রানী চক্রবর্তী। কৃষি বিভাগ থেকে সম্প্রসারিত বিভিন্ন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ এবং সাধারণ কৃষকের মধ্যে সম্প্রসারণে তার অবদান রয়েছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কারে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত
নীলফামারীর ডোমারের জৈব সার উৎপাদক ও গবেষক রাম নিবাস আগরওয়ালা সম্মাননা জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ১৯৯৫ সাল থেকে বিভিন্ন উন্নত মানের কেঁচো ও বিভিন্ন জৈব সার যেমন- গোবর, কচুরিপানা, কলাগাছ, খড়, হাড়ের গুঁড়া, শিংয়ের গুঁড়া, নিম খৈল, সয়াবিন খৈল, কাষ্ঠচূর্ণ, ঝিনুক চূর্ণ ইত্যাদি কাঁচামাল দিয়ে জৈব সার উন্নয়নে গবেষণা করে যাচ্ছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারে স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
নবাবগঞ্জের কমলাকান্দার অমিত ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মায়া রানী বাউল এআইপি হচ্ছেন। তিনি একজন সফল বাণিজ্যিক কৃষি খামারি। মায়া রানী বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারে স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
এ ক্যাটাগরিতে মনোনীত হয়েছেন পাবনা আটঘড়িয়ার সফল বীজ উৎপাদনকারী মো. আব্দুল খালেক। বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণে অসামান্য অবদান রাখায় তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন।
যে সুবিধা পাবেন এআইপিরা
‘কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নীতিমালা, ২০১৯’ অনুযায়ী, মনোনীতরা এআইপি কার্ডের সঙ্গে মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রশংসাপত্র পাবেন। এআইপির মেয়াদ হবে এক বছর (চলতি বছরের জুলাই থেকে পরের বছরের জুন মাস পর্যন্ত)।
এআইপিরা সচিবালয়ে প্রবেশের জন্য প্রবেশ পাস পাবেন। বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান ও সিটি/মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের নাগরিক সংবর্ধনায় আমন্ত্রণ পাবেন। বিমান, রেল, সড়ক ও জলপথে ভ্রমণকালীন সরকার পরিচালিত গণপরিবহনে আসন সংরক্ষণ অগ্রাধিকার পাবেন।একজন এআইপির ব্যবসা বা দাপ্তরিক কাজে বিদেশে ভ্রমণের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিসা পেতে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে উদ্দেশ্য করে লেটার অব ইন্ট্রোডাকশন ইস্যু করবে। একজন এআইপি তার স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা ও নিজের চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের কেবিন সুবিধা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাবেন; এবং বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ-২ ব্যবহারের সুবিধা পাবেন।
সুত্রঃ জাগোনিউজ