দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিতর্ক চলছে ব্রাহমা জাতের গরু আমদানি ও পালন নিষিদ্ধ কি না। সম্প্রতি এক ঘটনায় এ আলোচনা যেন আরও বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে মূল ধারার গণমাধ্যম; সবখানেই বেশ সরব ব্রাহমাকে অবৈধ আর নিষিদ্ধ প্রমাণে বা নিজের দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে।
তবে দেশে আসলেই কি ব্রাহমা জাতের গরু আমদানি ও পালন নিষিদ্ধ? দীর্ঘদিন ধরে কেন এই বিতর্ক চলে আসছে তা নিয়ে সরকারি আইন-কানুনের পাশাপাশি অভিজ্ঞজনরাও বলছেন ব্রাহমা নিষিদ্ধ নয়। দেশে দুধের উৎপাদন যেন না কমে- সে জন্য এটি বাণিজ্যিকভাবে লালনপালনে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
২০১৬ সালে করা বেসরকারি পর্যায়ে গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনার সংশোধিত নীতিমালাতে সিমেন আমদানি ও ব্যবহারে শর্ত জুড়ে দেওয়া থাকলেও কোথাও উল্লেখ করা হয়নি বাংলাদেশে ব্রাহমা গরু নিষিদ্ধ বা ব্রাহমার সিমেন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। ২০০৭ সালের জাতীয় প্রাণিসম্পদ নীতিমালাতেও ব্রাহমাকে নিরুৎসাহিত করার মতো কিছু উল্লেখ নেই।
ওই সময়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আইনুল হক ওই প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্রাহমা জাতের গরুর লালন-পালন কতটা বা কেন দরকার তা উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, বাংলাদেশে এর আগে একটি টেকসই, লাভজনক এবং অধিক মাংস উৎপাদনকারী গরুর কোনো জাত না থাকায় চাহিদার তুলনায় প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন অত্যক্ত কম ছিল। এরই মধ্যে দেশ মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন প্রয়োজন এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। একটি দেশীয় গরুর প্রাপ্ত বয়সে মাংস উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে মাত্র ৭০-৮০ কেজি, সেখানে ব্রাহমা জাতের একটি প্রাপ্তবয়স্ক (২০-২৪ মাস) গরুর মাংস উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ৭০০-৮০০ কেজি বা আরও বেশি। তাই, মাঠ পর্যায়ের কৃষক ও খামারিদের মধ্যে ব্রাহমা জাতের গবাদিপশু পালনে আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখা গেছে। এ প্রকল্প পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হলে ২-৩ বছর বয়সে একটি গরুর ওজন প্রায় ২৭ মণ বা এক টন পর্যন্ত হতে পারে। সঠিক মাত্রায় খাবার দিলে বাংলাদেশে একটি ব্রাহমা জাতের বাছুরের দৈনিক গড়ে ৯০০-১০০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি পায়।
ওই প্রকল্প মূল্যায়নের ৭ম অধ্যায়ে করা সুপারিশের ৪ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়, বাণিজ্যিক ব্রাহমা খামার স্থাপন ও পরিচালনার জন্য আগ্রহী খামারিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাসহ ফেসিলিটেটরের ভূমিকা পালন করতে হবে। আর ৮ নম্বর পয়েন্টে ব্রাহমা জাতের গরু লালন-পালনকে এগিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় টেকসই ও উপযোগী, এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং খামারিদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বিধায় প্রকল্প এলাকা ছাড়াও রিজিওলান ব্রিডিং পলিসির আলোকে এলাকাভিত্তিক এ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
এ মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলেন ওই সময়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহকারী প্রধান গাজী শরিফুল হাসান, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিকল্পনা সেল প্রধান মো. আবুল বাশার, পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ- আইএমইডির উপ-পরিচালক আফরোজা আকতার চৌধুরী, প্রকল্প পরিচালক এস এম এ সামাদসহ কয়েকটি বিভাগের প্রতিনিধি।
- আরও পড়ুন
সাদিক অ্যাগ্রোর আরেক খামারে সেই ছাগল, ১০ ব্রাহমা গরুর সন্ধান
শাহজালাল বিমানবন্দরে ব্রাহমা জাতের ১৮ গরু জব্দ
কম খরচে লাভবান হতে ব্রাহমা গরুই ভরসা
ব্রাহমা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ ইমরানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো আইন ও নীতিমালায় ব্রাহমা জাতের গরু লালন-পালন, সিমেন আমদানি ও বিধি মেনে ব্যবহারেও বাধা দেওয়া হয়নি। তবে, কেন যেন এই জাতের গরু লালন-পালন ও সম্প্রসারণে বাধা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক এস এম এ সামাদ জানান, তারও জানা নেই নতুন কোনো আইন করে ব্রাহমাকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কি না। তবে, এফআরসি মানে কী পরিমাণ খাবার খেয়ে কী পরিমাণ ওজন হবে সেই রেট ব্রাহমার অনেক ভালো। মাংসে চর্বির পরিমাণও তুলনামূলক কম। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কম পুঁজির খামারি বা গৃহস্থ বাড়িতে খুব সহজেই এই জাতের গরুর লালন-পালন করে বাজারে কমমূল্যে মাংসের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
তাহলে কেন এত বিতর্ক হচ্ছে দেশে ব্রাহমার লালন-পালন ও বাজারজাতকরণ নিয়ে? এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, বাংলাদেশের কোনো আইন-নীতিমালার কোথাও ব্রাহমা নিষিদ্ধ তা নেই। তারপরও আমরা বাণিজ্যিক পরিসরে এই জাতের গরু লালন-পালনের অনুমতি দেই না। যদিও মাংস উৎপাদনের জন্য এই জাতের গরুর খ্যাতি রয়েছে।
দেশে একদিকে গরুর মাংসের দাম বেড়ে নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অথচ এমন অবস্থায়ও ব্রাহমার মতো মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু পালনে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এটা কতটা যৌক্তিক?- এমন প্রশ্নে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ডিন ড. অধ্যাপক কে বি এম সাইফুল ইসলাম জানান, ব্রাহমা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ এমন তথ্য তার কাছে নেই। তবে, মাংস উৎপাদন করতে গিয়ে দুধের গরুর উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে এমন যুক্তিতে বিভিন্ন সভা সেমিনারে নিরুৎসাহিত করতে দেখেন তিনি।
ব্রাহমা ঘিরে এত আলোচনা সমালোচনার শুরু ২০২১ সালে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেসময় সাদিক অ্যাগ্রোর আমদানি করা ১৮টি গরু জব্দ করা হয়। হাইকোর্টের দেওয়া এক আদেশে দেখা যাচ্ছে, মিথ্যা ঘোষণায় ওই চালান আমদানির কথা বলা হলেও ব্রাহমাকে নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়নি ওই রায়ে।