লাম্পি স্কিন ডিডিজ মূলত আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক বার মহামারী আকারে দেখা গেলেও ভারতীয় উপমাহাদেশে রোগটি বিরল রোগ হিসাবে চিহ্নিত ছিল। ১৯২৯ সালে রোগটি প্রথম আফ্রিকার জাম্বিয়াতে দেখা যায় যা পরবর্তীতে ১৯৪৩ সাল থেকে ৪৫ সালের মধ্যে এই মহাদেশের বিস্তৃর্ণ এলাকার ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগের প্রাদুর্ভাবের ফলে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার গরু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং শত শত খামার ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। সত্তর ও আশির দশকে আফ্রিকার প্রায় সব দেশের গরু এই রোগে আক্রান্ত হয় । লাম্পি স্কিন ডিডিজ (এল এস ডি) কে আফ্রিকার গবাদিপ্রাণির endemic (নিয়মিত সংক্রামণ) রোগ হিসাবে পরিচিত ছিল। ২০১৩ সালে রোগটি প্রথম তুরস্কে এবং পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে মধ্য এশিয়ার কিছু অঞ্চলে এর প্রাদূর্ভাব ঘটে। মূলত রোগাক্রান্ত প্রাণী এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে পরিবহনের মাধ্যমে রোগটি ছড়ায় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
রোগের লক্ষণ
- আক্রান্ত গরুর প্রথমে জ্বর হয় যা ১০৪০ থেকে ১০৫০ ফাঃ হতে পারে এবং একই সাথে ক্ষুধা মন্দা দেখা যায়। জ্বরের সাথে নাক-মুখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়।
- গরুর শরীরের লিম্ফ নোডগুলির আকার বেড়ে যায়। প্রাণীর চামড়ার নিচে ফোস্কা বা পিন্ড দেখা যায়। ফোস্কা থেকে লোম উঠে যায় এবং ক্ষত সৃষ্টি হয়।
- আক্রান্ত প্রাণীর চোখ দিয়ে পানি পড়ে। চোখ লাল হয়ে যায় এবং চোখের কর্নিয়া ঘোলা হয়ে যেতে পারে।
- আক্রান্ত প্রাণীর মুখে ও পায়ে ক্ষত হয়। প্রাণীর চলা ফেরা এবং খাদ্য গ্রহণে সমস্যা হতে পারে।
- আক্রান্ত প্রাণীটি দিন দিন দূর্বল হয়ে যায়। রক্ত শুন্যতা সহ বিভিন্ন অপুষ্টিজনিত সমস্যা দেখা দেয়। এই রোগে (Morbidity) আক্রান্তের হার অনেক বেশী হলেও ভাল খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৃত্যুর (Mortality) হার কমানো সম্ভব।
- আক্রান্ত গাভীর দুধের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া, গর্ভপাত হওয়া, বন্ধ্যাত্বসহ ওজন অনেকাংশে কমে যায়। এ ছাড়াও এই রোগে প্রাণীর চামড়ার মান অত্যন্ত খারাপ হওয়ার কারণে এই রোগে খামারীর ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে থাকে।
চিকিৎসা
- রোগটি ভাইরাস এর কারণে হয় বিধায় ফলপ্রসু তেমন ভাল চিকিৎসা নাই। তবে রোগের লক্ষণ বিবেচনা করে চিকিৎসা দেয়া প্রাণী দ্রুত আরোগ্য লাভ করে। এই রোগে প্রাণী অত্যন্ত দূর্বল হয়ে যায় এবং প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়।
- আক্রান্ত প্রাণীর ফোস্কা বা পিন্ড ফেঁটে গেলে Povisep solution বা আয়োডিন মিশ্রণ দিয়ে পরিস্কার করতে হবে।
- ফোস্কাগুলি না ফাটলে ঐ গুলির উপর (চামড়ার উপরে) Povisep solution বা আয়োডিন দিয়ে রং এর মত প্রলেপ দেয় যায়।
- আক্রান্ত প্রাণীকে প্রচুর পানি বা চিটা গুড়ের সরবত খাওয়াতে হবে।
- বিভিন্ন মিনারেল মিশ্রণ যেমন- ফেরাস সালফেট, কপার সালফেট, কোবাল্ট মিশ্রণ, জিংক মিশ্রণ খাওয়াতে হবে।
- ভিটামিন-বি ইনজেকশনের মাধ্যমে এবং এন্টি হির্সট্রামিন (অহঃরযরংঃধসরহ), ব্যাথানাশক চধরহশরষষবৎ), এন্ট্রিপাইরেটিক (অহঃরঢ়ুৎবঃরপ) এবং আইভারমেকটিন (ওাবৎসবপঃরড়হ) গ্রুপের ঔষধ প্রাণীকে দিতে হবে। প্রয়োজন হলে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইম্মিউন সিরাম চিকিৎসা
ইম্মিউন সিরাম চিকিৎসা পদ্ধতিটি এই রোগ প্রতিকারের একটি অত্যন্ত কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সফলতার শতকরা হার ৫০ হতে ৯০ ভাগ। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ইম্মিউন সিরাম লাম্পি স্কিন ডিডিজ (এল এস ডি) রোগ হতে সেরে উঠা প্রাণী হতে সংগ্রহ করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রাণীর ওজন অনুযায়ী ৫-১০ সিসি ইম্মিউন সিরাম রোগাক্রান্ত গরুর শিরায় প্রয়োগ করতে হবে।
লেখকঃ ড. মোঃ গিয়াসউদ্দিন
সাবেক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট
সূত্র: আধুনিক কৃষি খামার।