এস এম মজিবুর রহমান, শরীয়তপুর, বাসস: ইচ্ছা শক্তির সাথে প্রবল মানসিক শক্তির সমন্বয় ঘটলে অসীম প্রতিকূলতাও যে হার মানে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর ইউনিয়নের হাজীপাড়া গ্রামের নুসরাত জাহান সিপা।
যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণের পর ২০২১ সালে নিজ বাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে শুরু করেন মাশরুম চাষ। পরিবারের সহযোগিতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পথ পেরিয়ে আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগে এখন প্রতি মাসে নুসরাতের আয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এতে শুধু সে স্বাবলম্বীই হয়নি পরিবারেও ফিরে এসেছে স্বচ্ছলতা। জয় করে নিয়েছেন উপজেলা জয়ীতা পুরস্কারও। এলাকার অনেক ক্ষুদ্র উদোক্তাদের অনুপ্রেরণা এখন নুসরাত।
তিন পুত্র সন্তানের জননী নুসরাত জাহান সিপা বাসস’কে বলেন, ২০০১ সালে এসএসসি পাস করার পর পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে আর পড়াশোনা করতে পারি নাই। একই বছর বাবা-মা পারিবারিকভাবে কোদালপুর ইউনিয়নের ক্ষুদ্র মুদি ব্যবসায়ী সেলিম আল মামুনের সাথে বিয়ে দেন। সময়ের সাথে সাথে টানা পোড়েনের মধ্যদিয়ে তিন সন্তানের লেখা-পড়া কোন রকমে চালিয়ে আসছিলাম।
বড় ছেলে আল সিহান এসএসসি’র গন্ডি পেরুনোর পর ছেলেদের পড়া-লেখার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাই ২০২১ সালে সাভারের জাতীয় মাশরুম সেন্টার থেকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের সঞ্চয়ের টাকা ও ধারদেনা করে ১০০ স্পন দিয়ে ছোট্ট একটি ঘরে শুরু করি মাশরুম চাষ। দুই মাসের ব্যবধানে ১০ হাজার টাকার মাশরুম বিক্রি করে শুরু হয় আমার স্বপ্ন যাত্রা।
ব্যবসার পরিসর বাড়াতে গোসাইরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সহায়তায় ২০২৩ সালে ৩ লাখ টাকা কৃষি লোন নিয়ে দুইটি ঘরে বড় পরিসরে শুরু করি। তিন বছরের ব্যবধানে আমার এখন ২ হাজার স্পনে মাশরুম উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি মাসে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় হয়। সাংসারিক সকল ব্যয় মিটিয়েও এখন আমার মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা সঞ্চয় থাকে।
আমার সাফল্য দেখে এখন অনেকেই আমার কাছ থেকে মাশরুম চাষের কৌশল শিখতে আসছেন। ইতিমধ্যে আমার কাছ থেকে শিখে ৪ জন মাশরুম চাষ শুরু করেছেন। আমার আশা আছে আগামীতে আামি একটি মাশরুম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করে এলাকার বিশেষ করে নারীদেরকে উদ্যোক্ত হিসেবে গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ। আমার উৎপাদিত মাশরুম এলাকায় অল্প পরিমাণ বিক্রি হলেও অনলাইনের মাধ্যমে সাভার, সিলেটসহ কিছু কিছু সারাদেশেই বিক্রি করছি। কষ্টকে মেনে নিয়ে কেউ যদি আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করে যায়, তাহলে সাফল্য তার আসবেই ইনশাআল্লাহ।
নুসরাতের স্বামী ক্ষুদ্র মদি ব্যবসায়ী সেলিম আল মাহবুব বলেন, প্রথম দিকে মাশরুম নিয়ে আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন দেখলাম মাশরুম বেশ লাভজনক, তখন থেকে ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে স্ত্রীকে সময় দিতে শুরু করলাম। এখন স্ত্রী’র আয়সহ আমার আয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চালিয়ে, ছেলেদের পড়া-লেখা চালিয়েও আমাদের সঞ্চয় হচ্ছে। আমাদের বাড়ি চরাঞ্চলে হওয়ায় এলাকায় মাশরুমের খুব একটা চাহিদা না থাকলেও অনলাইনের মাধ্যমে আমাদের সকল মাশরুমই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
গোসাইরহাট উপজেলার আলাওলপুর ইউনিয়নের নতুন উদ্যোক্তা বিল্লাল গাজী বলেন, নুসরাত আপার মাশরুমের ফলন ও লাভ দেখে তার কাছ থেকে শিখে ও পরামর্শ নিয়ে গত বছর আমি ছোট্ট একটি ঘরে একম স্পনে মাশরুম চাষ শুরু করি। এখন আমি দুইশ’ স্পনে মাশরুম চাষ করছি। মাসে আমার ৪-৫ হাজার টাকা ইনকাম হচ্ছে। আশা করছি আগামী বছর এক হাজার স্পনে মাশরুম চাষ করব।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, নুসরাত জাহানকে আমরা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছি। ২০২২ সালে উপজেলা কৃষি ঋণ মেলার মাধ্যমে ৪ শতাংশ হার সুদে ৩ লাখ টাকা ব্যবস্থা করে দেয়ায় তার ব্যবসার প্রসার এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
তার এ সাফল্য দেখে এখন এলকার অনেক নারীরাই মাশরুম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। নতুন উদ্যোক্তাদের বিশেষ করে নারীদের প্রাধান্য দিয়ে নুসরাত নিয়মিত মাশরুম চাষের কলা-কৌশল প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আশা করছি নুসরাতের সফলতার হাত ধরে ও পরামর্শ নিয়ে অনেক নারী-পুরুষও স্বাবলম্বী হয়ে কৃষি অর্থনীতিতে সহায়ক ভুমিকা রাখবেন।