৮০
ঢাকা,০৮/০৭/২৪ খ্রি।
বাংলাদেশে সর্ব প্রথম আনারস চাষের গোড়াপত্তন হয় ১৯৪২ সালে। মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক গারো সম্প্রদায়ের মিজি দয়াময়ী সাংমা প্রথম আনারস চাষ করেন। তিনি মেঘালয় থেকে ৭৫০টি চারা এনে তার বাড়িতে চাষ শুরু করেন। ওই চাষকে সমৃদ্ধ করে বতর্মানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আনারস চাষ হয়।
গত বছর মধুপুর উপজেলায় মোট ছয় হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে জায়ান্টকিউ জাতের চার হজার ৮৮ হেক্টর, হানিকুইন বা জলডুগি দুই হাজার ৭৪০ হেক্টর, এমডি-২ ১২ হেক্টর। এছাড়াও নতুন করে কৃষকদের মাঝে দুই লাখ ৭০ হাজার এমডি-২ জাতের আনারসের চারা বিতরণ করা হয়েছে।
কিছুদিন আগে আমি মধুপুর গিয়েছিলাম। আনারসে হরমোন কেন দেয়া হয়, তা নিয়ে অনেকের সাথে আলাপ করলাম। মধুপুর অঞ্চলের আনারসচাষীদের ভাষ্যমতে মোটাদাগে হরমোন দেয়ার কারন তিনটি।
১। সবগাছে একসাথে ফল আনা। তাই ফুল আসার আগে একবার হরমোন দেয়া হয়। এতে গাছে একসাথে ফল আসে, ফলসমূহ একসাথে পরিপক্ক হয়। ফসল ও জমি ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। আনারস গাছের বৃদ্ধির উপর ফল আসা নির্ভর করে। গাছের গ্রোথ ভালো হলে ফল আসে। তাই প্রাকৃতিকভাবে ৫০-৬০ ভাগ ফল একসাথে এলেও বাকীগুলো আগে পরে আসে। এই প্রেক্ষাপটে বানিজ্যিক আনারস চাষে হরমোন প্রয়োগের যৌক্তিকতা রয়েছে।
২। ফল আসার পর এটাকে বড় করার জন্য কয়েকবার গ্রোথ হরমোন প্রয়োগ করা হয়। অনেকে অধিকবার গ্রোথ হরমোন প্রয়োগ করার কারনে আনারস ফেটেও যায়। স্বাধ ও মিষ্টতা কমে যায়, সেল্ফ লাইফ কম হয়। কৃষকরা কমপক্ষে ২ বার গ্রোথ হরমোন দিয়ে থাকেন। তবে অনেকে বেশীও দেন। এটি সীমিত করা দরকার বা বাদ দেয়া যেতে পারে।
৩। ফল পরিপক্ক হওয়ার সময় এটিতে রঙ আনার জন্য আবার হরমোন দেয়া হয়। নাহলে ভালো বাজারমূল্য পাওয়া যায় না। আমি সবুজ আনারস মাঠে কেটে খেয়ে দেখে, অসাধারণ স্বাধ, মিষ্টতা ও জুসি। কিন্তু ক্রেতার নিকট আকর্ষণীয় করার জন্য হলুদ রঙ জরুরি। তাই হরমোন দেয়া হয়। তবে কৃষকদের ভাষ্য, এই হরমোন দিলে আনারস টাইট থাকে, পরিবহনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিন্তু হরমোন না দিলে পরিবহনের সময় ২০-২৫ ভাগ আনারস নষ্ট হয়। তাদের মতে হরমোন না দিলেও আনারসে রঙ আসে কিন্তু তখন অতি পরিপক্কতার কারনে পরিবহন করা যায় না।
আরেকটি বিষয় হলো সানবার্ন। আনারস যেহেতু উপরের দিকে থাকে তাই দুপুরের পরের রোদ যেদিকে পড়ে সেদিকে উপরের দিকে সানবার্ন হয়ে কালো হয়ে যায়। এ সমস্যা উত্তোরনের জন্য চাষীরা খড়কুটো বা আগাছা দিয়ে আনারস ডেকে দেয়। এটিও একটি বড় সমস্যা। আরেকটি বিষয় জানলাম, সেখানে ইন্ডিয়ান হরমোনের দাম ও চাহিদা বেশী। একই হরমোন দেশীয় থেকে ইন্ডিয়ান টা বেশী কার্যকর এবং দাম ১০-১২ গুন বেশী।
এবার আসি এমডি ২ আনারস নিয়ে। ফিলিপাইন থেকে সরকার বিশ্বখ্যাত এমডি ২ আনারস এনে মধুপুরের চাষিদের দিয়েছেন। আমি বিগত মধুপুর ভিজিটে প্রথম এমডি ২ আনারস খাই। তুলনা করার জন্য পাশাপাশি আমাদের স্থানীয় জাতের আনারসও খেয়ে দেখি। এমডি ২ নিসন্দেহে ভালো, তবে আমাদের স্থানীয় জাতসমূহ আকার, মিষ্টতা, রসে কোন অংশে কম নয়। এমডি ২ এর চোখগুলো বাহিরে থাকে বিধায় পিলিং লস কম হয়, আর এটার সেল্ফলাইফ কিছুটা বেশী। কিন্তু আমি মাঠে গিয়ে এমডি ২ আনারসের জমিতে পাতাপোড়া/টিপ ব্লাইট বেশী প্রত্যক্ষ করেছি।
সামগ্রিকভাবে আনারসে যথেচ্ছ হরমোন প্রয়োগের কথা চালু আছে যা কৃষকদের কাছে ভিটামিন নামে পরিচিত। কিন্তু এ বিষয়ে কৃষকের প্রয়োজনের জায়গায় দাঁড়িয়ে আনারসে হরমোন প্রয়োগে একটি যৌক্তিক সুপারিশ প্রদান করা প্রয়োজন।
লেখকঃ
প্রফেসর নোমান ফারুক
প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগ, শেকৃবি।