সকালের সূর্য ওঠার সাথে সাথে, “স্টাবলিশমেন্ট অফ বিএলআরআই টেকনোলজি ভিলেজ এড রিজিওনাল ষ্টেশন” (Establishment of BLRI Technology Village at Regional Station) প্রকল্পের মাঠ কর্মীরা বেরিয়ে পড়েন প্রান্তিক খামারিদের বাড়িতে বাড়িতে। উদ্দেশ্য প্রান্তিক পর্যায়ের একটি পল্লীর সকল খামারিকে আধুনিকায়ন, সফল ও সাবলম্বী খামারি হিসেবে গড়ে তোলা। মডেল একটি গ্রাম তৈরি করা যেখান থেকে সংশ্লিষ্ট জেলার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর প্রান্তিক খামারিরাও উপকৃত হবেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই কর্মসূচির নাম “প্রযুক্তিপল্লী” বা “টেকনোলজি ভিলেজ” নামে পরিচিত। প্রথম পর্যায়ে ২০১৮ সালের জুন মাসে ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার শরীফবাগ গ্রামকে এই প্রজেক্টের আওতায় এনে, সফল প্রযুক্তি পল্লীতে রূপান্তর করছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। অল্প কিছুদিনের মধ্যে ২০২২ সালের জুন মাসে, দেশের পাঁচটি জেলার একটি করে গ্রামকে প্রযুক্তি পল্লীর আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তিনজন ডিভিশনাল ফিল্ড অফিসারের আওতায় প্রতিটি গ্রামে দুই থেকে চারজন মাঠকর্মী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রযুক্তিপল্লী বাস্তবায়নে।
প্রযুক্তি পল্লীতে আধুনিক, দক্ষ ও সফল খামারি তৈরীতে সকল ধরনের সহযোগিতা করে থাকে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। খামারিদের পশু পালনে নানাবিধ সহায়তার পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে ভিটামিন ও কৃমিনাশক, খুড়ারোগ, লাম্পি স্কিন ডিজিজ, পিপিআর, রানীক্ষেত, ডাগপ্লে ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি চলমান আছে। এছাড়াও খামারীদের স্বাবলম্বী করতে গরু, ছাগল, মুরগি বিনামূল্যে প্রদান ও গো-খাদ্য বিতরণ করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি খামারিদের পশু লালন পালন ও ভ্যাকসিন দেয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মাঠকর্মীরা।
এতে বিভিন্ন জেলায় সফল খামারির সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি অসচ্ছল পরিবারগুলো স্বচ্ছলতায় ফিরতে খামারি হয়ে উঠছে । বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেয়া এই উদ্যোগ, জনসাধারণ ও পল্লী এলাকার প্রান্তিক খামারিরা আশার আলো হিসেবে দেখছেন। এমনটাই মনে করছেন সচেতন মহল।
ঢাকা জেলার ধামরাই শরিফবাগ গ্রামের, সফল প্রযুক্তি পল্লীর, খামারি সনিয়া আক্তার, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর পক্ষ থেকে তিনটি বিনামূল্যে ছাগল নিয়ে শুরু করে তার খামার। ছয় মাসের ব্যবধানে ২০টি ছাগল হয়েছে তার। পাশাপাশি ছাগল মোটা তাজা করনে পিলেট খাদ্য তৈরি ও ভ্যাকসিন দেয়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে, একজন সফল খামারি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সে। তার দেখাদেখি গ্রামের অন্যান্য অসচ্ছল পরিবারগুলো খামারি হয়ে উঠছেন। এতে পাল্টে যাচ্ছে এই গ্রামের দারিদ্রতার চিত্র।
অপর আরেক সফল গরু খামারি আরহাম এগ্রো ফার্মের মালিক, মহসিন মিয়ার দাবি গরুর রোগ বালাই মুক্ত করণে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচির আওতায় এসে খামারকে করেছেন রোগ মুক্ত ।
একই গ্রামে দশ বছর ধরে গরু মোটাতাজাকরণ করে আসছেন খামারি আরিফুর রহমান। তিনি বলেন শুরুর দিকটা ছিল অনেক চ্যালেঞ্জিং ও ভীতিকর। যখন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর প্রযুক্তি পল্লীর আওতায় আমাদের গ্রাম এসেছে, তখন থেকে আমার খামার ব্যবসার ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হয়েছি। কারণ এখন আমি নিজে গরু মোটাতাজাকরণে আধুনিক পদ্ধতি, ভ্যাকসিনেশন ও পশুর রোগ বালাই সম্পর্কে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এটা বর্তমান সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের, খামারিদের জন্য নেয়া যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলাফল।
প্রযুক্তি পল্লীর ভেড়া খামারি রেজিনা আক্তার জানান গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের ধীরে ধীরে সফল খামারি হতে দেখে আমি স্বাবলম্বী হতে ভেড়া পালনের উদ্যোগ নেই। সরকারের প্রযুক্তি পল্লীর কর্মসূচি দেখে আমি সাহস করি। বিএলআরআই এর ফিল্ড অফিসার বোরহান ভাইকে আমার উদ্যোগের কথা জানালে সার্বিক সহযোগিতা করেন তিনি আমাকে। ভেড়া পালনের উপর ছোট ছোট ট্রেনিং ও বিভিন্ন রোগবালয়ের ঔষধপত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমাকে। এখন আল্লাহর রহমতে আমার সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
প্রযুক্তি পল্লী প্রকল্পের ডিভিশনাল ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট তরিকুল ইসলাম বলেন, এভাবে বাংলাদেশের ছয়টি জেলায় কার্যক্রম শুরু করেছে মৎস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। আমরা চলতি মাসে ধামরাই উপজেলার প্রযুক্তি পল্লীতে ৫ শত গরু ৬ শত ছাগল ২ হাজার মুরগি ৩শত ভ্যাড়া ভ্যাকসিনেশন সম্পূর্ণ করেছি। অন্যান্য জেলাগুলোতে কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
আরেক ডিভিশনাল ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট বোরহান উদ্দিন বলেন আমরা ঢাকা জেলাকে একটি সফল প্রযুক্তিপল্লী উপহার দিতে পেরেছি । যখন কৃষকের সফলতা ও আনন্দ দেখতে পাই তখন সকল পরিশ্রম সার্থক মনে হয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলা ও গ্রাম থেকে খামারি ও বিভিন্ন এনজিও এসেছেন আমাদের সফল প্রযুক্তিপল্লী শরীফবাগ গ্রাম পরিদর্শনে । এখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যান্য গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে প্রযুক্তি পল্লীর বিভিন্ন সফলতা।
বিএলআরআই টেকনোলজি ভিলেজ এড স্টেশন রিজিওনাল ষ্টেশন (Establishment of BLRI Technology Village at Regional Station) প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ফার্নিং সিস্টেম রিসার্চ ডিভিশনের বিভাগীয় প্রধান ডঃ রাজিয়া খাতুন বলেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন মহোদয়ের দিকনির্দেশনায় প্রান্তিক পর্যায়ে খামারিদের আধুনিকায়ন ও সফল খামারি হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যক্রম শুরু করেছি। আমরা প্রযুক্তি পল্লীর কর্মসূচিতে জনসাধারণ ও প্রান্তিক খামারিদের ব্যাপক সারা ও উদ্দীপনা পেয়েছি। প্রথম পর্যায়ে ধামরাই উপজেলার শরীফবাগ গ্রামে প্রযুক্তি পল্লীর আওতায় এনে কার্যক্রম শুরু করি।
এখানে ৩৫০ জন বিভিন্ন পর্যায়ের খামারীদের সফল আধুনিক খামারি করণে বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম ও অনুদান দিয়েছি। নিয়মিত কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে খামারিদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা করেছি। পল্লী এলাকার খামারিদের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এই কর্মসূচি ফরিদপুর, রাজশাহী, সিরাজগ, যশর, চট্টগ্রামে নতুন করে একটি করে গ্রামকে প্রযুক্তি পল্লীর আওতায় এনে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এ এল আর ডি (অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্ট) এর মাধ্যমে আমাদের প্রযুক্তিপল্লীর সফল কর্মসূচি গুলো দেশের অন্যান্য পল্লী এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই ২০ মার্চ (সোমবার) থেকে ২২ মার্চ (বুধবার ) পর্যন্ত এ এল আরডি(অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্ট) তথা জাতীয় নীতি অ্যাডভোকেসি কৃষি সংস্কার, প্রচার, শক্তিশালীকরণ এবং নেটওয়ার্কিং সংস্থার সঙ্গে কর্মশালা চলবে।
সংগ্রহীত সূত্র: আজকের দর্পণ