মোঃ শাহরিয়ার হায়দার১, ড. মোঃ আব্দুল মালেক২
বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের সহজলভ্য ও সুলভ উৎস হলো পোল্ট্রি খাতভুক্ত মুরগি হতে প্রাপ্ত ডিম ও মাংস। উৎপাদিত মাংসের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ মুরগি পালন উপখাত হতে সরবরাহ হয়ে থাকে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মুরগি পালন প্রযুক্তির সম্প্রসারণে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। এক্ষেত্রে, সম্প্রসারিত প্রযুক্তির আওতায় জীব-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মুরগির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রযোজ্য সহায়ক পরিবেশের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এরূপ সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে মুরগিতে বিভিন্ন ধরনের ধকল সৃষ্টিকারী নিয়মকসমূহ প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এ পর্যায়ে মুরগিতে বিভিন্ন ধরনের ধকল এবং তাপ ধকল এর বিষয়ে আলোচনা করা হলো :
ধকল
ধকল এমন একটি পরিবর্তিত অবস্থা/পরিস্থীতি যেমন- অধিক তাপ, ভীতি ইত্যাদি যার সাথে খাপখাওয়ানোর জন্য প্রাণীকে তার স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ও আচরণগত বহিঃপ্রকাশের পরিবর্তে অস্বাভাবিকতা প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়। পোল্ট্রি বিশেষত বাণিজ্যিক লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগিতে ধকলের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের ধকল
প্রাণীতে প্রভাব বিস্তারকারী ধকলসমূহ যেমন- সামাজিক; শারীরবৃত্তীয়; মানসিক ইত্যাদি। ধকলের কারণ হতে পারে বিভিন্ন রকম। যেমন : শিকারী প্রাণী (তুলনামূলক বৃহৎ প্রাণী); রোগের সংক্রমণ; তাপমাত্রার পরিবর্তন; প্রজনন; স্থানান্তর বা পরিবহন; টিকা, কৃমিনাশক ও চিকিৎসা প্রদান; পুষ্টিগত; শব্দ; পরিবেশগত; প্রাণী প্রদর্শনী ইত্যাদি
উল্লেখ্য, বাণিজ্যিক মুরগি যেমন- লেয়ার, ব্রয়লার ইত্যাদিতে উপর্যুক্ত ধকলসমূহের মধ্যে তাপমাত্রার পরিবর্তনজনিত ধকলের প্রভাব মারাত্মকভাবে পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশে মার্চ মাস হতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত গরম তথা উষ্ণতার তীব্রতা পরিলক্ষিত হয়। এই সময়ই মূলত পোল্ট্রি তথা মুরগিতে তাপ ধকলের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
মুরগির সুস্থ থাকা এবং তা হতে অধিক উৎপাদন পেতে পরিবেশের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখা আবশ্যক। এক্ষেত্রে, নির্দেশিত তাপমাত্রা হলো ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মুরগিতে তাপ ধকলের দুই ধরনের প্রভাব যথা ক) প্রত্যক্ষ বা দৃশমান প্রভাব এবং খ) পরোক্ষ বা অদৃশ্য বা শারীরবৃত্তীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
প্রত্যক্ষ বা দৃশমান প্রভাব : প্রত্যক্ষ প্রভাবসমূহ যেমন – মুরগি হাঁ করে নি:শ্বাস নিতে ও হাঁপাতে পারে এবং হিট স্ট্রোক এ মারা যেতে পারে; দৈহিক ওজন ও দৈহিক বৃদ্ধিও হার হ্রাস পেতে পারে মাংসের গুণগতমান হ্রাস পেতে পারে; খাদ্য রূপান্তরের হার হ্রাস পায় যা আর্থিক ক্ষতির কারণ; পাখা ঝুলে যেতে পারে;পানি গ্রহণ বেড়ে যেতে পারে; ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে; মুরগিতে অসাড়তা, স্নায়ুবিক ভারসাম্যহীনতা ও খিচুনি দেখা দিতে পারে; মুরগির বিষ্ঠায় পানির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে এবং পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে; অলসতা প্রদর্শন করতে পারে ও ঝিমাতে পারে; আক্রমণাত্মক আচরণ প্রদর্শন করতে পারে; মারামারি করতে পারে; ঠোকরাঠুকরি করতে পারে; দৈহিক ওজন ও দৈহিক বৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে পারে মাংসের গুণগতমান হ্রাস পেতে পারে; খাদ্য রূপান্তরের হার হ্রাস পায়, যা আর্থিক ক্ষতির কারণ; মুরগির চামড়ায় রক্ত জমার কারণে কালচে দেখাতে পারে; পালকের রং বিবর্ণ ও চামড়া রুক্ষ হতে পারে; ডিম উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে; ডিমের আকার ছোট হতে পারে; ডিমের খোসা পাতলা হতে পারে; বাচ্চা ফোটানোর জন্য উৎপাদিত ডিমের উর্বরতা হ্রাস পেতে পারে; প্যারেন্টস্টক মুরগির উর্বরতা হ্রাস পেতে পারে ইত্যাদি।
পরোক্ষ বা অদৃশ্য বা শারীরবৃত্তীয় প্রভাব : পরোক্ষ প্রভাবসমূহ যেমন : রক্তের প্লাজমা রসের পিএইচ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে; কোষের পিএইচ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে; খনিজ লবণের শোষণ কমে যেতে পারে; ইলেকট্রলাইট-এর ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে; রক্তে স্ট্রেস হরমোনের উপস্থিতি দেখা দিতে পারে; তাপ ধকল সংক্রান্ত প্রোটিন সক্রিয় হয়ে মেটাবলিজম বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে তাপসহনশীল টিস্যুকে রক্ষা করে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
পোল্ট্রি তথা মুরগিতে তাপ ধকলের প্রভাবের কারণ : বিশ্বের অধিকাংশ প্রাণী তার শরীরের তাপের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে শরীরে উৎপাদিত প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাপ ৪টি পদ্ধতিতে যেমন : বিকিরণ, পরিচলন, পরিবহন ও বাষ্পীভবন শরীর থেকে বের করে দেয় বা প্রশমিত করে। কিন্তু পোল্ট্রি তথা মুরগির শরীরে ঘর্মগ্রন্থি না থাকায় বাষ্পীভবন ব্যতীত বর্ণিত ৩টি পদ্ধতিতে তারা শরীরে উৎপাদিত অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয়। এর ফলে মুরগি তার শরীরে উৎপাদিত অতিরিক্ত তাপ হাঁ করে নি:শ্বাসের মাধ্যমে বের করে দেয়। এক্ষেত্রে, অধিক আর্দ্রতার পাশাপাশি পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সেসময় মুরগি তার শরীরের তাপের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে হাঁ করে নি:শ্বাসের মাধ্যমে অধিক হারে তাপ প্রশমনে ব্যর্থ হলে মুরগিতে হিট স্ট্রোক হয় এবং মুরগি মারা যায়। উল্লেখ্য, শরীরে তাপের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে বাষ্পীভবন পদ্ধতি বিশেষ কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তাপ ধকল প্রতিরোধে করণীয় : পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত ঘরে মুরগিতে তাপ ধকল হয় না বললেই চলে। তবে উন্মুক্ত ঘরে বাণিজ্যিক মুরগি পালনে তাপ ধকলের দৃশমান প্রভাব রয়েছে। উন্মুক্ত ঘরে বাণিজ্যিক মুরগিকে তাপ ধকলের প্রভাবমুক্ত রাখতে নি¤েœাক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।
মুরগির জাত নির্বাচন : মাংস উৎপাদনের জন্য দেশের বিভিন্ন ধরনের দেশি মুরগি যেমন : কমন নেটিভ, গলাছিলা, হিলি ইত্যাদি সহ সংকরজাতের সোনালি মুরগি পালন করা যেতে পারে কারণ এদের তাপ সহ্য করার ক্ষমতা বেশি। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু কোম্পানি যেমন : তাপসহনশীল বাণিজ্যিক ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা যেমন : বাউ মুরগি ইত্যাদি বাজারজাত করছে সেগুলোও পালন করা যেতে পারে। একইভাবে জাত বিবেচনায় লেয়ার মুরগির বাচ্চা নির্বাচন করে পালন করা যেতে পারে।
আবাসন ও বায়ু প্রবাহ : শেড নির্মাণের জন্য নির্বাচিত স্থানটি উঁচু ও উত্তম বায়ু চলাচল সম্পন্ন হওয়া জরুরি। শেডটির দৈর্ঘ্য পূর্ব-পশ্চিম বরাবর নির্মাণ করতে হবে। সঠিক বায়ু প্রবাহের জন্য শেডের উত্তর-দক্ষিণ পার্শ্বে দেয়াল নেট দ্বারা নির্মিত হওয়া আবশ্যক। শেডের মেঝে মাচা বা মাচা কাম ফ্লোর প্রকৃতির হওয়া বাঞ্ছনীয়। শেডের ছাদটি মনিটর বা সেমি. মনিটর টাইপ মডেলে তৈরি করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি ছাদ নির্মাণে টিন ব্যবহার না করে অ্যাসবেস্টস ব্যবহার করা যেতে পারে। শেডের আকার বিবেচনায় ফ্যান দেয়া অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়াও ছাদের নিচের অংশে তাপ নিরোধক ইনসুলেটর দেয়া যেতে পারে। বর্ণিত বিষয়সমূহ নিশ্চিত করলে শেডে মুরগির জন্য সহনীয় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। দিনের মধ্যভাগ অর্থাৎ সকাল ১১টা হতে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পানিতে স্যালাইন, ভিটামিন-সি, প্রাকৃতিক বিটেইন ইত্যাদি প্রদান করা যেতে পারে। ভিটামিন-সি পাউডার পাওয়া না গেলে লেবুর রস ব্যবহার করা যেতে পারে।
দিনের বেলা শেডের যে পার্শ্ব দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করে সে পার্শ্বে পর্দা ঝুলিয়ে/নামিয়ে দেয়া। অত্যধিক গরমকালীন সময়ে শেডে মুরগির ঘনত্ব বা সংখ্যা বেশি থাকলে, কিছু সংখ্যাক মুরগিকে সম্ভাব্যতা বিবেচনায় অন্য সেডে স্থানান্তর করা যেতে পারে। সোনালি মুরগি বা লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে শেডের ভেতর কিছু সংখ্যাক পার্চ/বাঁশ ঝুলিয়ে দেয়া যেতে পারে। মুরগির উপর ৪-৫ ফুট উচ্চতা হতে পানি স্প্রে করা যেতে পারে। উল্লেখ্য সরাসরি মুরগিতে স্প্রে না করাই উত্তম। শেডের ছাদ টিন দ্বারা নির্মিত হলে তাতে ভেজা চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দেয়া যেতে পারে।
মুরগির ঘনত্ব : শেডের আকার বিবেচনায় মুরগির নির্দিষ্ট জাত অনুযায়ী নির্দেশিত সংখ্যাক মুরগি পালন করতে হবে। মুরগির সংখ্যা বেশি হলে তাপ ধকলের প্রভাব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা : দিনের উষ্ণতম সময়ে খাদ্য প্রদান না করে শীতলতম সময়ে অর্থাৎ সকাল বেলা ও বিকেল বা সন্ধ্যাবেলা খাদ্য প্রদান করলে মুরগিতে তাপ ধকলের প্রভাব কম পরিলক্ষিত হবে। উক্ত সময় খাদ্যের পাত্র খাদ্য দ্বারা পরিপূর্ণ রাখতে হবে। লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে খাদ্যের সাথে সোডিয়াম বাইকার্বনেট নির্দেশিত মাত্রায় মিশ্রিত করে খাওয়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি খামারে সার্বক্ষণিক সুপেয় পানির সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। খামারে ন্যূনতম ৫-৬ বার পানি পরিবর্তন করে দেয়া আবশ্যক হবে।
লেখক : ১ব্যবস্থাপক, ২মহাব্যবস্থাপক, সমন্বিত কৃষি ইউনিট, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন, (পিকেএসএফ), আগারগাঁও, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৪৫৬৬৮৮৫৫