এবার স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখেছে ফেনী, নোয়াখালীসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের চার জেলা। কমবেশি মোট আক্রান্ত জেলা ২৭টি। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠছে দগদগে ক্ষত। জানমালের পাশাপাশি বড় ক্ষতি হয়েছে মৎস্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতের, যা টাকার অংকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটিরও বেশি।
বন্যা পরবর্তীসময়ে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে মাঠে থাকা আমন ধান, ফসল, শাক-সবজি, আদা হলুদ, আখ, পান, মাছের ঘের, গরু-ছাগল ও পোল্ট্রির খামারগুলো ভেসে গেছে। তবে মৎস্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে নতুন সরকার।
ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার হবিগঞ্জসহ আরও কয়েক জেলায় বন্যায় আমন ধানের বীজতলার মধ্যে অধিকাংশ আক্রান্ত হয়েছে। পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ ধান।
বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শুরু করায় কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দুর্গত এলাকায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী মাঠে রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে সব রকমের সহায়তা দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।- কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারলে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য ধানের চারা, মাছের পোনাসহ সার, বীজ ও কীটনাশক নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
২৩ জেলায় ফসলের ক্ষতি
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, এবার কমবেশি ২৭ জেলা বন্যার কবলে পড়েছে। এর মধ্যে ২৩টি জেলার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর। মোট ফসল উৎপাদনে ক্ষতি ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২১৪ টন। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৮৯ জন।
ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে আউশ ধান ছিল ৩৮ হাজার ৬৮৯ হেক্টর, রোপা আমন আবাদ ১ লাখ ৪১ হাজার ৬০৯ হেক্টর, বোনা আমন ৭৬৪ হেক্টর এবং আমন বীজতলা ১৪ হাজার ৯০৮ হেক্টর।
ধান ছাড়াও শাক-সবজি, আদা, হলুদ, ফলবাগান, মরিচ, পান, তরমুজ, পেঁপে, টমেটোসহ আরও কিছু ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন ফসলের ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২১৪ টন উৎপাদন একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে।
আক্রান্ত ২৩ জেলায় বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়েছিল ১৪ লাখ ৩০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে। গড়ে এ ফসলের ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতির এ তালিকায় আমন-আউশ ধানের পরই রয়েছে শাক-সবজি। ১ লাখ ৭৬ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি নষ্ট হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শুরু থেকে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দুর্গত এলাকায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী মাঠে রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে সব রকমের সহায়তা দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত জেলায় ৮০ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দিয়েছে। যার মধ্যে ধানবীজ, সার ও নগদ অর্থ সহায়তা অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে কৃষকদের জন্য ১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্যার কারণে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়। আবার নতুন করে কৃষি উৎপাদন নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হয় কৃষকদের। বীজ ও সার কোথা থেকে পাবেন, এ নিয়ে কৃষক ও বর্গাচাষিরা অনিশ্চয়তায় পড়েন। ফলে বন্যার পর এখন কৃষি পুনর্বাসনের দিকে সরকারকে দ্রুত মনোযোগ দিতে হবে।’
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, দিঘি, খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। ক্ষতিগ্রস্ত পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ৩ হাজার ৭৪৬ লাখ। দুধ, ডিম, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ এখন পর্যন্ত এ খাতে ৪১১ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি
তিনি বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব আমনের চারা ও বীজ এবং পরবর্তীসময়ে সারের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে কৃষক ও খামারির সহায়তা করা যেতে পারে।’
এদিকে গত সপ্তাহে দ্রুততম সময়ে আমনের বীজতলা তৈরি, বন্যাকবলিত এলাকার নিকটতম এলাকায় বীজতলা প্রস্তুত করা, মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের বন্যাত্তোর কৃষি পুনর্বাসনের কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে শুরু করা, বন্যাকবলিত এলাকায় ব্লক এবং উপজেলাভিত্তিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
মাছের ক্ষতি দেড় হাজার কোটি টাকা
বন্যায় মৎস্য খাতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১২টি জেলার শুধু মৎস্য খাতের ক্ষতিই ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। এছাড়া বন্যাকবলিত অন্য জেলায়ও আরও কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের ওই হিসাব বলছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, দিঘি, খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। ক্ষতিগ্রস্ত পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ৩ হাজার ৭৪৬ লাখ এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুধ, ডিম, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগিসহ এখন পর্যন্ত এ খাতে ৪১১ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে।
মাছ উৎপাদনে কুমিল্লা জেলা বাংলাদেশে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এখানে নদ-নদী, পুকুর, দিঘি, জলাশয় ও প্লাবনভূমিতে জেলার চাহিদার দ্বিগুণের বেশি মাছ উৎপাদন হয়। কিন্তু এবারের চলমান বন্যায় মাছ উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কুমিল্লা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে প্রাথমিকভাবে এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪শ কোটি টাকা নিরূপণ করা হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে বলেও জানান মাছ চাষিরা।
কুমিল্লায় ২৩ হাজার ৪২টি খামার বা পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আয়তনে যা ৫ হাজার ৮৩৫ দশমিক ৬১ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত এসব খামার থেকে ২৫ হাজার ৫৩৮ দশমিক ৫০ টন ফিন ফিশ, ১০ দশমিক ২৮ টন চিংড়ি, ১০ কোটি ১৭ লাখ পোনামাছের ক্ষতি হয়েছে। বাজারমূল্য হিসাবে মাছে ৩৫৮ কোটি ১২ লাখ, চিংড়িতে ৫ কোটি ও ১৭ কোটি ৮ লাখ ৯২ হাজার টাকার পোনাজাতীয় মাছের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ২২ কোটি ৯৫ লাখ টাকার পুকুর, খামার বা স্লুইস গেটের অবকাঠামোর ক্ষতি এবং ৮০ লাখ টাকা মূল্যের জাল বিনষ্ট হয়েছে। কুমিল্লার মতো এমন মাছের ক্ষতি হয়েছে আরও ১১ জেলায়।
পোল্ট্রি খামারির ক্ষতি ৫৬৭ কোটি টাকা
বন্যায় ওইসব জেলায় চার হাজার পোলট্রি খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে ৫৬৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ)।
এ সংগঠনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আকস্মিক বন্যার ব্যাপারে কারও কোনো ধারণা ছিল না। যার কারণে কোনো খামারিই আগেভাগে মুরগি সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়নি। কারণ ওইসব জেলায় বন্যা হয় না সাধারণত। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরা সরকারের সহযোগিতা না পেলে সংকটে পড়বে দেশের ডিম ও মুরগির বাজার।’
বন্যার পানিতে কত মুরগি মারা গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চার জেলায় ডিম পাড়া লেয়ার মুরগি মারা গেছে প্রায় ৫ লাখ। যার বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকা। ব্রয়লার মুরগি মারা গেছে ৪০ লাখ। যার বাজার মূল্য ৯৬ কোটি টাকা। সোনালি মুরগি মারা গেছে ৩০ লাখ। যার বাজারমূল্য ৭২ কোটি টাকা। মুরগির বাচ্চা মারা গেছে প্রায় ১৫ লাখ। যার বাজারমূল্য ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
একই সঙ্গে মুরগির খাবার নষ্ট হয়েছে প্রায় ৫ হাজার টন, যার বাজার মূল্য ৩৫ কোটি টাকা। আবার চার হাজার খামারে জিনিসপত্র ও স্থাপনা নষ্ট হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ ৩২০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে চার জেলায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ৫৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য জরুরিভিত্তিতে ভর্তুকিমূল্যে ফিড, মুরগির বাচ্চা ও ভ্যাকসিনসহ নগদ প্রণোদনা এবং জামানতবিহীন ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবিও জানান তিনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, মাছের খামার সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সহায়তা, বন্যাকবলিত এলাকায় মাছের পোনা বিতরণের জন্য তহবিল, উন্নত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা এবং বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাছচাষিদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়াতে কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে বলে জানান।