এমপক্স হলো অরথোপক্স ভাইরাস গোষ্ঠীর অন্তর্গত একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ, যা আগে মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল। ডেনমার্কে গবেষণার জন্য নিয়ে আসা বানরের মধ্যে প্রথমবার ভাইরাসটি ধরা পড়ে। পরবর্তী সময়ে এটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে স্থানান্তরিত হয় এবং বর্তমানে এটি মানুষ থেকে মানুষেও ছড়ায়। শুরুর দিকে এমপক্স মূলত ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোসহ কিছু আফ্রিকান দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল।
ভাইরাসের ধরন: এমপক্স ভাইরাস দুটি প্রধান ক্লেডে বিভক্ত। ক্লেড ১ ও ক্লেড ২। ক্লেড ১ সাধারণত মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোয় পাওয়া যায় এবং এর মৃত্যুহার তুলনামূলক বেশি। ক্লেড ২ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোয় দেখা যায় এবং এটি দ্রুত ছড়ায়, তবে এর মৃত্যুহার কম। ২০২২ সালে ক্লেড ২বি দ্বারা একটি বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব ঘটে, যার মধ্যে ভারতে ৩০ জন রোগী শনাক্ত হয়। বর্তমানে আফ্রিকায় ক্লেড ১বি-এর প্রাদুর্ভাব চলছে, কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারতে এখন পর্যন্ত কোনো সুনিশ্চিত বা সন্দেহজনক ঘটনা পাওয়া যায়নি।
ঝুঁকি ও বিস্তার : আফ্রিকায় এমপক্সে আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগই ১৫ বছরের নিচে হলেও এটি সবার জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। আফ্রিকার বাইরের দেশে, বিশেষত সমকামী পুরুষদের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। যদিও অন্যান্য জনগোষ্ঠী যেমন স্বাস্থ্যকর্মী, কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে, সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক, তাদের বিছানায় ঘুমালে বা একই কাপড় ব্যবহারে সংক্রমণ ঘটতে পারে। মুখ থেকে নিঃসৃত লালার মাধ্যমেও সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে।
লক্ষণ
এমপক্সের লক্ষণ সাধারণত অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগের মতোই: জ্বর, ফুসকুড়ি, লিম্ফ গ্রন্থি (লসিকা গ্রন্থি) ফুলে যাওয়া, মাথাব্যথা, পেশির ব্যথা এবং ক্লান্তি। আক্রান্তের চার-পাঁচদিন পরে শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, যা প্রথমে ম্যাকিউল, পরে প্যাপিউল, ভেসিকল এবং শেষে পাসটিউল হিসেবে প্রকাশ পায়। এ ফুসকুড়ি শরীরের যেকোনো অংশে হতে পারে, এমনকি যৌনাঙ্গেও। রোগটি সাধারণত দুই-চার সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
চিকিৎসা
ত্বকের ফুসকুড়ি বা ফোসকা থেকে নমুনা নিয়ে পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে এমপক্স নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ল্যাবকে এ পরীক্ষার জন্য নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে এমপক্সের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তাই উপসর্গ ও লক্ষণের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
প্রতিরোধ ও সুরক্ষা
এমপক্সের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কয়েকটি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত:
- মৃত প্রাণীর সংস্পর্শ এড়ানো
- সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ পরিহার
- বিছানা বা পরিধেয় কাপড় শেয়ার না করা
- নিরাপদ যৌন আচরণ পালন করা
জনসচেতনতা: এমপক্সের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মধ্যে এমপক্সের লক্ষণ, ঝুঁকি ও প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে কাজ করতে হবে। জনসাধারণকে নিয়মিত হ্যান্ডওয়াশিং, সঠিক শ্বাসনালি সুরক্ষা বা মাস্ক পরিধান এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধির মাধ্যমে ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ করতে উৎসাহিত করতে হবে। স্কুল, কলেজ, অফিস ও অন্যান্য সামাজিক স্থানে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ দ্রুত ওই রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জানতে পারে, রোগটি চিহ্নিত করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
আইডিএইচ, মহাখালীর ভূমিকা: সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল (আইডিএইচ) মহাখালী ঢাকা শহরের একটি প্রধান স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে এমপক্সের ঝুঁকি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। হাসপাতালটি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাসংক্রান্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। এরই মধ্যে এ হাসপাতালে সন্দেহজনক এমপক্স রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটি আইসিইউ সুবিধাসহ মোট ১০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত রয়েছে এবং আইইডিসিআরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর সঠিক চিকিৎসা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও আপডেট পাচ্ছেন। তবে যতক্ষণ না কার্যকর একটি টিকা পাওয়া যায়, ততক্ষণ আমাদের সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই প্রধান সুরক্ষা।
লেখক: কনসালট্যান্ট, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা
সূত্র: বণিক বার্তা