প্রবাদ আছে, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। কারণ, মাছ বাঙালির একটু বেশিই প্রিয়। তাছাড়া নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় মাছের প্রাচুর্যতাও বেশি। তবে আজকাল ব্যস্ততার কারণে অনেকেই বাজার থেকে মাছ কেনার পর বাসায় গিয়ে তা কাটার ঝামেলা নিতে চান না। তাই মাছ কেনার পর অনেক ক্রেতাই এখন শরণাপন্ন হচ্ছেন মাছ কাটিয়াদের কাছে। স্থানীয়ভাবে তাদেরকে ‘মাছ কাটিয়া’ বা ‘মাছ কুটনি’ বলা হয়।
বাজার থেকে ক্রেতারা মাছ কিনে পাশেই ধারালো বটি নিয়ে বসে থাকা মাছ কাটিয়াদের কাছে দিচ্ছেন। তারা মাছ কেটে, ধুয়ে পরিষ্কার করে পলিথিন ব্যাগে ভরে দিচ্ছেন। বিনিময়ে মাছের আকারভেদে নির্ধারিত পরিমাণ টাকা দিয়ে ক্রেতারা সেই মাছ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। এমন চিত্র গাইবান্ধা শহরের পুরাতন বাজারের। মাছের বাজারের পাশেই ধারালো বটি নিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসে মাছ কাটছেন সদর উপজেলার গোদারহাট গ্রামের নিতাই দাসের ছেলে রকি দাস। রকি বলেন, ‘আমার বাবা প্রায় পাঁচ বছর থেকে এই ব্যবসা করেন। আমি বেকার ঘুরে বেড়াতাম। কিছুদিন আগে থেকে সকালে আমিও তাকে সময় দেই। প্রতিদিন মাছ কেটে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হয়। ভাগ্য ভালো হলে ৮০০ টাকাও হয়।’ এই আয় দিয়ে তাদের সংসার ভালোই চলছে বলেন রকি।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, শহরের পুরাতন বাজারে মাছ কাটিয়ার কাজ করেন আট থেকে দশজন। মাছের আকার ভেদে কেজিপ্রতি মাছ কাটতে তারা নেন ২০ থেকে ৩০ টাকা। তবে, এক কেজি ছোট মাছ কাটতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা নেন। তাদের দিন-রাত মিলে গড়ে আয় আয় হয় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। সপ্তাহের বন্ধের দিনগুলোতে বাজারে ক্রেতা বেশি থাকায় কিছুটা বাড়তি আয় হয়। তাই সপ্তাহের বন্ধের দিনের আশায় থাকেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় অন্যের মাছ কাটাকেই নতুন কর্মসংস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন কিছু মানুষ। যদিও অন্যের মাছ কাটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার আগে এই শ্রমজীবীর প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন।
শহরের সবুজ পাড়ার যুবক হৃদয় মিয়া। আগে একটি কসমেটিকসের দোকান চাকরি করতেন। প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা বেতনে শহরে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। ৪ মাস আগে তিনি একটি ধারালো বটি কিনে শহরের পুরাতন বাজারে মাছ কাটার কাজে নেমে পড়েন। তিনি বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অর্ধেক বেলা মাছ কাটেন। তাতে ৫০০ টাকার মতো আয় হয়। এই আয়ে তিনি সন্তুষ্ট।
শহরের পুরাতন বাজারে মাছ কাটিয়ার কাজ করেন শহরের ব্রিজরোড কালিবাড়ি পাড়ার মিলন চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, পাঁচ বছর আগে ভারতে প্রথম তার মাছ কাটার কাজের হাতে খড়ি। নতুন এই ব্যবসার আইডিয়া পেয়েছেন তার এক জামাই বাবুর (দুলাভাই) কাছে। এই পেশায় আয় কেমন হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাছ কাটলে তার আয় হয় ৪০০-৫০০ টাকা। রাত পর্যন্ত করলে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকাও হয়। তবে শুক্রবার সরকারি ছুটি থাকার কারণে মাছের চাহিদা বেশি থাকে। সরকারি কর্মকর্তারা বাজার থেকে বেশি বেশি মাছ কুটে বাড়ি নিয়ে যান।
শহরের সালিমার সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী আনারুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘বর্তমানে বাসায় কাজের লোকের সমস্যা। বাড়িওয়ালিও রান্নাবান্না আর ঘরের জরুরি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই সময় বাঁচাতে, বাজার থেকে মাছ কিনে পরিষ্কার করে নিয়ে যাচ্ছি। এতে করে বাড়তি কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না।’
শহরের ব্রিজরোড এলাকার গৃহিণী রোজিনা ইসলাম। তিনি বলেন, বর্তমানে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া, স্কুল, কোচিং এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এরপর আবার রান্নাবান্নার কাজ করতে হয়। তাই মাছ কাটার তেমন সময় হয় না। বাড়তি ২০–৩০ টাকা খরচ হলেও সময় অল্প লাগে, ঝামেলা থেকেও বেঁচে যায়।
পুরাতন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহ সভাপতি রফিকুল ইসলাম লুলু বলেন, ‘মাছ কেটেও যে সংসার চালানো যায় এটা আগে অনেকেই ভাবতেন না। বাজারে মাছ কেটে এবং মাছে আঁইশ বিক্রি করে অনেকেই এখন স্বাবলম্বী।’
তিনি আরও বলেন, সব পেশাতেই এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। আগে স্ত্রী ও মা চাচিরা বাড়িতে মাছ কাটতেন, এখন সেটা বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। ভবিষ্যতে গ্রামে-গঞ্জে শহরের মতো মেশিনের মাধ্যমে মাছ কাটা প্রথা চালু হতে পারে।
সূত্র: সমকাল