লেখা:
২০০১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের কোনো এক সন্ধ্যায় কচিখালী অফিসের পুকুরপাড়ে টর্চ নিয়ে বসে আছি। ডানে, বাঁয়ে গভীর অন্ধকার বন। এতে কিছুটা ভয় কাজ করছে। পেছনটায় পুকুর, আর সামনে বিস্তৃত ঘাসবন। সকাল-বিকেল কচিখালীর এই ঘাসবনে নেমে পড়ে হরিণের দল। সন্ধ্যা রাতেও খেতে আসে দল বেঁধে। গাঢ় অন্ধকারে টর্চের আলো ফেললে হরিণের দল কিছুটা হকচকিয়ে যায়। এ সময় হরিণেরা আলোর দিকে তাকায়, ফলে চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। দূর থেকে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে এক জোড়া করে আলো জ্বলতে থাকে। এমন মনোরম দৃশ্য দেখতেই আমরা বসেছি পুকুরপাড়ে।
সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এই হরিণ। বিশেষ করে সুন্দরবনের ঘাসবনে এই হরিণ সহজে চোখে পড়ে। সকাল-বিকেল নেমে পড়ে খাবারের খোঁজে। কেউ দলে, কেউ আসে একা একা। বাচ্চারা আসে মায়ের পিছু পিছু। দলে কয়েকটি স্ত্রী হরিণের সঙ্গে থাকে এক বা একাধিক পুরুষ হরিণ। সবাই মিলে ঘাসবনে নেমে এলে দেখতে দারুণ লাগে। সোনালি থেকে লালচে বাদামি দেহের ওপর ছোপ ছোপ গোলাকার সাদা ফোঁটা থাকে। এমন বৈশিষ্ট্য থেকেই এ হরিণে নাম দেওয়া হয়েছে চিত্রা হরিণ। এরা চিতা হরিণ বা চিতাল নামেও পরিচিত। ইংরেজিতে এদের নাম স্পটেড ডিয়ার আর লাতিন ভাষায় অ্যাক্সিস অ্যাক্সিস।
সুন্দরবনের অধিকাংশ অঞ্চলে কমবেশি চিত্রা হরিণ দেখা যায়। তবে কটকা, কচিখালী, নীলকমল ও মান্দারবাড়িয়ার ঘাস বনসমৃদ্ধ বিস্তীর্ণ এলাকা চিত্রা হরিণের আদর্শ আবাস। সকাল-বিকেলে এসব ঘাসবনে দলবলে বেরিয়ে পড়ে।
চিত্রা হরিণ তৃণভোজী। ঘাস, লতাপাতা, তৃণ, ফল-মূল, গাছের বাকল ইত্যাদি প্রধান খাবার। তবে কেওড়া, ছইলা, কাঁকড়া ও বাইনের পাতা ও ফল এদের খুব পছন্দ। এ ছাড়া খলশি, গরানের কচিপাতা, কালি লতা, বাউলি লতা এদের প্রিয়। কচি উলু ঘাস এদের অন্যতম পছন্দের খাদ্য। সুন্দরবনে বানরের সঙ্গে এদের সখ্যের নানা গল্প জেলে-বাওয়ালিদের মুখে শুনতে পাওয়া যায়।
সুন্দরবনে বাঘের প্রধান শিকার চিত্রা হরিণ। বাঘের মোট খাবারের মধ্যে চিত্রা হরিণ জোগান দেয় প্রায় ৮০ শতাংশ। তাই সুন্দরবনে বাঘ রক্ষা করতে হলে আগে এই চিত্রা হরিণ বাঁচাতে হবে।
তবে পরিতাপের বিষয়, দেশের একশ্রেণির মানুষ সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ শিকার করে ভূরিভোজনের জন্য। অনেক পর্যটক সুন্দরবনে গিয়ে হরিণের মাংস খেতে চান। দেশের একশ্রেণির ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালী সুন্দরবনের হরিণের মাংসের লোভ দমন করতে পারেন না। আপনাদের বলি, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি—সবই তো আপনার হাতের নাগালে। চাইলে আপনি মরুর দেশের উট-দুম্বাও জোগাড় করে ফেলতে পারেন। বাঘের তো এই হরিণ ছাড়া খাওয়ার তেমন কিছুই নেই। আপনাদের দুর্দমনীয় লোভ থেকে মুক্তি দিন না সুন্দরবনের হরিণকে।
- এম এ আজিজ: বাঘ ও বন্য প্রাণী গবেষক