শহুরে কোনো স্কুলশিক্ষক যখন ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙছেন, তখন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার গ্রামের এক শিক্ষক নেমে গেছেন পুকুরে। যখন কোনো শিক্ষক হয়ত মাসকাবারি সম্মানীর বিনিময়ে এক ব্যাচ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ানো শেষ করেছেন, ততক্ষণে ওই শিক্ষক পুকুর থেকে কয়েক হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছেন।
স্কুল থেকে ফিরে কোনো শিক্ষক যখন টিউশনের জন্য কোনো শিক্ষার্থীর বাসায় ছুটছেন, তখন ওই শিক্ষকের বাড়িতে ছুটে আসছেন আম, লিচুর ক্রেতারা।
এভাবে পুকুরে মাছ আর পাড়ে আম, লিচুর বাগান গড়ে অবসর সময় কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে মোটা আয় করছেন ওই শিক্ষক। একইসঙ্গে শুরু করেছেন গরুপালন। পুকুরেরই একাংশে করছেন ধানচাষও।
বহুমুখী এই খামারি ডুমুরগাছা গ্রামের শামসুল আলম দুলু। তিনি ডুমুরগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকও। স্কুলে তাঁর হাজিরাও রয়েছে ঠিকঠাক।
ডুমুরগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মনিরুল আলম বলেন, ‘শামসুল আলম পরিশ্রমী শিক্ষক। আমি অফিসের কাজে বাইরে গেলে স্কুলের দায়িত্বে উনিই থাকেন। তখনও স্কুল ঠিকমতোই চলে।’স্কুলের সময় ঠিক রেখেও শুধু ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমকে পুঁজি করে নিজের অবসরকে সোনালি সময়ে পরিণত করেছেন শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমি স্কুল ও বাজারের বাইরে অযথা সময় কম কাটাই। বাকি সময়টা পরিবার ও খামারে দিই।’
এলাকাবাসী ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, শামসুল আলম ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতেন খেতে খামারে। বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি পরিবারের হাল ধরেন। তখনই খামার গড়ায় মনোযোগ দেন। প্রায় ৪ বিঘার একটি পুকুর কেটে মাছের চাষ শুরু করেন। পাড়ে নিজ হাতে লাগান লেবু, লিচুর চারা। কিন্তু সম্পত্তি ভাগাভাগি হওয়ায় এতে ছন্দপতন ঘটে। নিজের গড়া পুকুর হাতছাড়া হয়ে যায়। কয়েক বছর তিনি বিরতি নেন। এরপর আবার আস্তেধীরে সব গড়ে তুলছেন। শামসুল আলমের এই সফলতা দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন অনেকে। আয়ের বিকল্প উৎস তৈরি করছেন তাঁরাও।
পাশের কুমারগাড়ী গ্রামের মশকুর মণ্ডল বলেন, ‘একটা চাকরি করেও শামসুল ভাই যেভাবে খামারে সময় দেন তা দেখে আমিও অনুপ্রাণিত হই। তাঁর পরামর্শে ব্যবসার পাশাপাশি মাছের খামার গড়ায় মনোযোগ দিয়েছি।’
২০১৬ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শামসুল। পরের বছর বদলি নিয়ে নিজের গ্রামে আসেন। এরপর খামার গড়লেও পারিবারিক জটিলতায় ছন্দপতন ঘটে। সর্বশেষ সব গুছিয়ে ২০২২ সালে তিনি আবার খামার শুরু করেন।
শামসুল বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর খেতখামার করার প্রতি আগ্রহ ছিল। ফলে চাকরি পেয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়েই খামার গড়ায় মন দিয়েছেন।
সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, ডুমুরগাছা গ্রামের একেবারে উত্তরপ্রান্তে সড়কের দুপাশে লাগোয়া চারটি পুকুর। এর দুটি শামসুল আলমের। হাতের বাম পাশ ধরে এগোলে বাড়ির লাগোয়া দক্ষিণপ্রান্তে আরও দুটি পুকুর। এ দুটিই শামসুলের। এ দুটি পুকুরের পাড়ে আম, লিচুর সারি। সাথী ফসল হিসেবে রয়েছে লাউ, ঝিঙে, ঢ্যাঁড়সের আবাদ।
শামসুল বলেন, এই পুকুরটিই তাঁর হাতছাড়া হয়েছিল। আবার ফিরে পেয়ে এর প্রতি ইঞ্চি কাজে লাগাচ্ছেন।
ডুমুরগাছা পার হলে উত্তর দিকে পলাশবাড়ী উপজেলার কুমারগাড়ী গ্রাম। এর প্রথমেই পাশাপাশি দুটি পুকুর। এ দুটি পুকুরও ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করেছেন শামসুল।
শামসুল বলেন, তিনি হ্যাচারি থেকে রেণু এনে ছাড়ছেন এক পুকুরে। সেই রেণু যখন পোনায় পরিণত হয়, তা নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন আরেক জলাশয়ে। পোনা আরেকটু বড় হলে ছাড়া হচ্ছে আরেকটা পুকুরে। সেখান থেকে চলছে পোনা বিক্রি। এটিই তাঁর আয়ের মূল উৎস। এরপরও পুকুরে যে পোনা থাকছে তা নিজেই পালন করছেন আরও দুটি পুকুরে। সেখান থেকেও বিক্রি করছেন মাছ।
চাকরিতে ঢোকার আগে শামসুল কৃষিতে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিয়েছেন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অধীনে করেছেন কৃষি, মাছ ও গোবাদি পশুপালনের ওপর প্রশিক্ষণ।
শামসুল জানান, পুকুর পাড়ের লিচু থেকে তিনি গত মৌসুমে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় করেছেন। আর মাছের খামার থেকে তিনি এ বছর অর্ধ লক্ষ টাকা আয় করতে চান।
শিক্ষকতার পাশাপাশি সফল এ খামারি বলেন, গ্রামে প্রাইভেট পড়িয়ে ঠিকমতো টাকা পাওয়া যায় না। আবার মাস শেষে শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরাও ঠিকঠাক টাকা দিতে চান না। তাই তিনি আয়ের বিকল্প ও বাড়তি উৎস হিসেবে খামার করা বেছে নিয়েছেন
সূত্র :জুমবাংলা নিউজ