ইলিশের ভরা মৌসুম এখন। পাঁচ বছর ধরে উৎপাদনও বাড়ছে আড়াই শতাংশ হারে। তবু ইলিশের স্বাদ নিতে পারছে না সাধারণ ক্রেতারা। কারণ উচ্চমূল্য। ভোক্তারা এজন্য অসাধু চক্রের কারসাজিকে দায়ী করছেন। তাদের অভিযোগ, অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। এ চক্র না ভাঙলে ইলিশ সাধারণ মানুষের কাছে অধরা থেকেই যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদী বা সাগর থেকে ইলিশ আহরণের পর ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে কয়েকটি হাত ঘোরে ইলিশ। প্রথমত জেলের কাছ থেকে যায় মহাজনের হাতে। এরপর আড়তদার হয়ে যায় পাইকারদের কাছে। সর্বশেষ যখন খুচরা ব্যবসায়ী কিংবা পাড়া-মহল্লার বাজারে পৌঁছায় তখন ইলিশের দাম এমন পর্যায়ে ওঠে যে, তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।
ইলিশ উৎপাদন এলাকার ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, প্রতিদিনই অনেক ইলিশবোঝাই ট্রাক খুলনা, যশোর ও বেনাপোলের দিকে যায়। এগুলো শেষ পর্যন্ত সেসব এলাকায় বিক্রি হয়, নাকি পাচার হয়– তা খতিয়ে দেখা দরকার।
সরবরাহ ভালো, তবু দাম চড়া
ঢাকায় মাছের অন্যতম বড় পাইকারি মার্কেট কারওয়ান বাজার। এখান থেকে মাছ বিভিন্ন বাজারে যায়। গত রোব ও সোমবার এই বাজারের কয়েকটি আড়ত ঘুরে দেখা যায়, ইলিশের সরবরাহ পর্যাপ্ত। সাধারণত ব্যবসায়ীরা চাঁদপুরের ইলিশ বললেও লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক ট্রাকে ইলিশ আসছে।
বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, অন্য মাছের তুলনায় ইলিশের দাম ভিন্ন হওয়ার মূল কারণ ওজন। যে ইলিশ যত বড়, তার দর তত বেশি। এক কেজি ২০০ থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের ইলিশ আড়তে ১৪৫০ থেকে ১৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারেই এ মাছ খুচরায় ১৬৫০ থেকে ১৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দর পাইকারিতে ১২০০ থেকে ১২৫০ টাকা, যা খুচরায় বিক্রি হয় ১৩০০ থেকে ১৪৫০ টাকায়। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দর পাইকারিতে ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা, যা খুচরা বাজারে ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া খুচরায় ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা আর ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ছোট আকারের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে খুচরায় ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে।
পাইকারি ও খুচরায় কেজিতে ব্যবধান থাকে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।
দাম বাড়ায় কারা
কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, পাইকার ও মহাজন পর্যায়ে কারসাজি এবং রপ্তানির অনুমতি দেওয়ায় দাম কমছে না ইলিশের। পাইকারি ইলিশ বিক্রেতা জাকির হোসেন সমকালকে বলেন, জেলে ইলিশ ধরার পর তারা কত দরে মহাজনের কাছে বিক্রি করে, সেখান থেকে পাইকাররা কত দরে কিনে এনে ঢাকায় বিক্রি করে তা ধাপে ধাপে তদন্ত করলে সিন্ডিকেট ধরা পড়বে।
তাঁর মতে, কয়েক বছর ধরে ভারতে পূজার সময় অল্প কিছু ইলিশ রপ্তানি হয়। কিন্তু এটাকে পুঁজি করে বড় ব্যবসায়ীরা ঘাটতি দেখায়। তাছাড়া মৌসুমে বেশি পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়লেও তা সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহ করা হয় না। বেশির ভাগ ইলিশ রাখা হয় হিমাগারে। এভাবে সংকট তৈরি করে তারা দাম বাড়িয়ে দেন।
বাবুল নামের আরেক ইলিশ বিক্রেতা দাবি করেন, ইলিশের উৎপাদন কম। কিন্তু চাহিদা কমে না। বরং বছরে বছরে বাড়ে। এজন্য দাম বেশি।
অজুহাত রপ্তানির
পাঁচ-ছয় বছর ধরে সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়ে আসছে। পূজা উপলক্ষে এবার সরকার তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। তবে পাঁচ বছর ধরে অনুমতি দিলেও রপ্তানি খুব বেশি পরিমাণে হয়নি। গত পাঁচ বছরে ভারতে ইলিশ রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৯৮ টন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রপ্তানির ঘোষণায় কিছু ব্যবসায়ী মজুত করা শুরু করেছেন। উৎপাদন এলাকা বরিশালের ইলিশ বাজারে তার কিছুটা প্রভাব পড়েছে। নগরীর পোর্ট রোড ইলিশ মোকামে সব আকারের ইলিশের দাম কেজিতে ২০০ টাকার মতো বেড়েছে। এখানকার মৎস্য ব্যবসায়ী লিয়া আড়তঘরের স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন সমকালকে জানান, রপ্তানির খবরে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বিপুল পরিমাণ ইলিশ কিনে নিচ্ছে। এগুলো মজুত করে পরে রপ্তানির অনুমতি পাওয়া ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হতে পারে।
চাঁদপুরেও চলছে মজুতের প্রক্রিয়া। এ জেলার সবচেয়ে বড় মৎস্য অবতরণ ও বিপণন কেন্দ্র বড় স্টেশনের মৎস্য বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শবেবরাত বলেন, চাঁদপুরে ভরা মৌসুমেও ইলিশের সংকট। যে পরিমাণ মাছ ধরা পড়ে, তা দিয়ে স্থানীয় ক্রেতা ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ক্রেতাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। এ সময় ঘাটে মাছ থাকার কথা একশ থেকে দেড়শ টন। অথচ মাছ আসছে ৩০ থেকে ৪০ টন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চাঁদপুরের উপপরিচালক নুর হোসেন রুবেল বলেন, এমনিতেই দাম বেশি। ভারতে ইলিশ পাঠানোর একটা প্রভাব পড়বেই। তবে বাজারে তদারকি থাকবে।
পাচার হয় কিনা দেখা দরকার
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি)। সেখানে গত দুই সপ্তাহে ইলিশের দাম মণপ্রতি বেড়েছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে গতকালই বেড়েছে ২ হাজার টাকা। গতকাল সেখানে এক কেজির বড় ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৭২ থেকে ৭৪ হাজার টাকা মণ (৪০ কেজিতে মণ)। মাঝারি ওজনের ইলিশ (৭৫০-১০০০ গ্রাম) বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৬৭ হাজার টাকা মণ এবং ৫০০ থেকে ৭৫০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৫৭ হাজার টাকা মণ।
বিএফডিসির এক আড়তদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতি বছর দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ইলিশ রপ্তানি হয়। তবে বছরজুড়ে কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ চলে যায়। প্রতিদিন পাথরঘাটা বিএফডিসি থেকে যে পরিমাণ ইলিশের ট্রাক ঢাকাসহ সারাদেশে যায়, এর চেয়ে বেশি মাছের ট্রাক খুলনা, যশোর এবং বেনাপোলের দিকে যায়। এত ইলিশ কি শুধু খুলনা এবং যশোরের মানুষ কেনে?
পাথরঘাটা বিএফডিসির সহকারী মার্কেটিং অফিসার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, দাম বাড়ার ক্ষেত্রে রপ্তানি মূল অনুঘটক নয়। সাগর ও নদী থেকে ইলিশ শিকারে আধুনিক প্রযুক্তির জাল ব্যবহার করে বড় হওয়ার আগেই নিধন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশীয় প্রজাতির অসংখ্য মাছ বিলুপ্ত হওয়ায় ইলিশের ওপর চাপ বাড়ছে।
দেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ ইলিশ। জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। জেলেরা বছরে প্রায় ছয় লাখ টন ইলিশ আহরণ করেন, যার বেশির ভাগই আসে সাগর থেকে।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে ইলিশ উৎপাদন বেশ বেড়েছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতি বছর উৎপাদন হচ্ছে পাঁচ লাখ টনের বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার সমকালকে বলেন, যারা সিন্ডিকেট করে, তারা এমনিতেই দাম বাড়ায়। এখন তারা রপ্তানির সুযোগও নিচ্ছে। নিজেরাই ঘাটতি তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। অবৈধ পথেও ইলিশ যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই বিষয়টি বিজিবি, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে নজরে রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাজার তদারকির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভোক্তা অধিদপ্তরকে বিষয়টি অবহিত করা হবে, যাতে ক্রেতারা বাজারে গিয়ে না ঠকেন।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন বরিশাল, বরগুনা ও চাঁদপুর প্রতিনিধি)
সূত্র : সমকাল