৯
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:৩৭ এএম (ভিজিট : ৩২২)
মা ইলিশ ও জাটকা ধরায় কড়াকড়ির কারণে দেশে গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের উৎপাদন অনেক বাড়লেও দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির সিদ্ধান্তের খবরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, গত কয়েক বছর ধরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রফতানির যে পরিমাণ অনুমোদন দেওয়া হয় তার এক-তৃতীয়াংশও রফতানি হয় না। বরং পাচারের মাধ্যমে অবৈধ পথেই ইলিশ নিতে বেশি আগ্রহ ব্যবসায়ীদের।
রফতানির কারণে দেশের বাজারে ইলিশের জোগান কম থাকা এবং দাম বেড়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগে ২০১২ সালের পহেলা আগস্ট থেকে ইলিশ রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর এখন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। তবে ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছর পূজার সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৩ থেকে ৫ হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, যেটি এবারও দেওয়া হয়েছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৩ হাজার টন রফতানির অনুমতি দেওয়া হলেও ১ হাজার টন রফতানি হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ গত বছর ৭৯টি প্রতিষ্ঠানকে ভারতে ৩ হাজার ৯৫০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়া হলেও রফতানি হয়েছিল মাত্র ৮০২ টন। অর্থাৎ অনুমতির এক-চতুর্থাংশও রফতানি হয়নি। ২০২৩ সালে প্রতি কেজি ইলিশ মাছের রফতানি মূল্য ছিল ১০ ডলার বা ১ হাজার ৯৮ টাকা এবং ৮০২ টন রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল ৮০ লাখ ডলার। রফতানি হওয়া ইলিশের ওজন এক কেজির কম ছিল। এর আগে ২০২২ সালে ভারতে ৪ হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেওয়া হলেও রফতানি হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৩৫২ টন। এতে আয় হয়েছিল ১৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা (১ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার)।
এ ছাড়া ২০২১ সালে ১ হাজার ২৩০ টন ইলিশ রফতানি করে আয় হয়েছিল ১ কোটি ২৪ লাখ ডলার। তখন প্রতি কেজির রফতানি মূল্য ছিল ১০ ডলার। ২০২০ সালে ১ হাজার ৬৯৯ টন ইলিশ রফতানি করে আয় হয়েছিল ১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এবং ২০১৯ সালে ৪৭৬ টন ইলিশ রফতানি করে আয় হয়েছিল ৩৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৯ সালে প্রথম পূজা উপলক্ষে ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা জানান, রফতানি বন্ধ থাকায় অবৈধ পথে বিদেশে ইলিশ পাচার হয়। এ ছাড়া শুল্ক না লাগার কারণে পাচার হওয়া ইলিশের প্রতি ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বেশি থাকে।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ২ লাখ ৯৮ হাজার টন হলেও বর্তমানে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে ইলিশের ভরা মৌসুমেও কম দামে কিনতে পারছেন না দেশের মানুষ। অভিযোগ রয়েছে জেলেদের একটি সিন্ডিকেট মাঝনদী থেকেই ইলিশ বিক্রি করে দিচ্ছে ভারতীয় পাচারকারীদের কাছে। সীমান্ত দিয়েও পাচার হচ্ছে।
মৎস্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ দশমিক ২২ শতাংশ, যার বাজারমূল্য ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় এক শতাংশের অধিক। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। বাংলাদেশের ইলিশ পেয়েছে জিআই পণ্যের মর্যাদা। দেশে-বিদেশে ইলিশ মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। তবে স্বাদের দিক থেকে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আর মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৮০ ভাগই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশ ইলিশ রফতানি না করায় স্বাদে কম হলেও ইলিশের সেই বাজারটি দখল করে নিয়েছে মিয়ানমার। আর অবৈধভাবেও ভারতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশ। চোরাকারবারির একটি গ্রুপ মাছ ফ্রিজিং করে ভোমরা বর্ডার দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়। এ কারণেও স্থানীয় বাজারে মাছের সংকট এবং মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও বাজারে এর প্রভাব তেমন একটা পড়ছে না। বিশেষ করে বাজারে যেমন পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না তেমনি দামও অনেক বেশি।
বর্তমানে বাজারভেদে এক কেজি ওজনের প্রতিটি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা দামে। আর দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম চাওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। বিশ্বের যেসব দেশে বাঙালি বসবাস করেন, সেসব দেশেই মূলত ইলিশের চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় এ চাহিদা সবচেয়ে বেশি। রফতানি বন্ধ থাকলেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বাজারে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে যা বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশ বলে বিক্রি করা হয়। তাই প্রশ্ন উঠেছে রফতানি করা না হলে এগুলো কীভাবে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, বিদেশে বাংলাদেশের ইলিশের বেশি চাহিদা থাকায় তারা ইলিশ রফতানি উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সরকার অনুমোদন না দেওয়ায় ক্রেতারা মিয়ানমার বা অন্য দেশ থেকে অর্ডার করে নেয়। তার মতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন হলেও বিদেশে রফতানির ইলিশ রফতানির চাহিদা রয়েছে বছরে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার টন। এ সামান্য ইলিশ রফতানি হলে দেশের বাজারে কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়। বরং এটি রফতানির সুযোগ পেলে বাংলাদেশের ব্যবসার সুযোগ আরও বাড়বে।
রফতানি বন্ধ থাকার পরও বিভিন্ন দেশের বাজারে ইলিশ কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে জানতে চাইলে মৎস্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত ছাড়া অন্য দেশে ইলিশ পাচার হওয়ার সুযোগ খুবই কম। তাই বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের ইলিশের কথা বলা হলেও তা মিয়ানমার বা অন্য দেশের ইলিশ হতে পারে। কারণ তাদের তো আর ইলিশ রফতানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানিয়েছেন, দেশের মানুষের জন্য ইলিশের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইলিশ রফতানি না করার কথা বলেছিলেন তিনি। তবে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতের বিশেষ অনুরোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে। তিনি বলেন, দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ টনেরও বেশি। আর মাত্র ৩ হাজার টন রফতানির সিদ্ধান্ত হলেও কতটুকু রফতানি হবে সেটি এখনও বলা যাচ্ছে না। তাই অল্প পরিমাণ রফতানির সিদ্ধান্তে বাজারে ইলিশের দামে কোনো প্রভাব পড়বে না।