কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জনগণের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। দেশের কৃষির প্রধান ফসল ধান। মানুষের খাদ্যতালিকার মূল উপাদান চালের চাহিদা পূরণে দেশের বেশিরভাগ কৃষি জমিতে মৌসুমভেদে ধান চাষ হয়। প্রচলিত জাতের পাশাপাশি উন্নত, উচ্চফলনশীল ও জলবায়ু সহিষ্ণু বিভিন্ন জাতের ধানের উদ্ভাবন ও কৃষকদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় আওতাধীন দপ্তর ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে কাজ করছে। দেশে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে ধান চাষ করা হয়। ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি ও ক্রমবর্ধিষ্ণু জনগণ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাথে আছে খরা, বন্যা, জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা, শৈত্যপ্রবাহ ও শিলাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব মোকাবিলা করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদ করলে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন সম্ভব।
এখন উইন্টার ক্রপ হিসেবে পরিচিত আমন মৌসুম চলমান। জুলাই-আগস্টে আমন বপন সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে আমনের পরিচর্যা। চলতি মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের বিভিন্ন জেলা প্লাবিত হয়েছে। এতে আমনের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছে এবং কিছু জায়গায় রোপণ বিলম্বিত হয়েছে। আমন ধান কৃষকের কাছে একটি নিরাপদ ফসল হিসেবে বিবেচিত। আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়, যেমন- উপযুক্ত জাত ও ভালো বীজ নির্বাচন, জমি তৈরি, সঠিক বয়সের চারা সময়মতো রোপণ, আগাছা দূরীকরণ, সার ও পানি ব্যবস্থাপনা, সম্পূরক সেচ এবং রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা ফলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমন উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট তাদের উদ্ভাবিত জাতগুলো ব্যবহার করলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদন সম্ভব।
প্রতিকূল পরিবেশে চাষযোগ্য জাত
খরা প্রবণ এলাকার জন্য উপযোগী জাত: ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১। বন্যা প্রবণ এলাকার জন্য উপযোগী জাত- ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২, ব্রি ধান৭৯, বিনাধান-১১, বিনা ধান-১২। লবণাক্ত এলাকার জন্য উপযোগী জাত- বিআর২৩, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮। জোয়ার-ভাটা প্রবণ অলবণাক্ত এলাকার জন্য উপযোগী জাত- বিআর২৩, ব্রি ধান৪৪, ব্রি ধান৫২, ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭। লবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকার জন্য উপযোগী জাত- ব্রি ধান৭৮, বিনাধান-২৩। অলবণাক্ত জলাবদ্ধ এলাকার জন্য উপযোগী জাত- বিআর১০, বিআর২৩, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৭৮, ব্রি ধান ৭৯, বিনা ধান-২৩। মধ্যম নিচু (পানির উচ্চতা ১ মিটার পর্যন্ত হয়) এলাকার জন্য উপযোগী জাত- ব্রি ধান ৯১।
পাহাড়ি (ভ্যালি) এলাকার জন্য উপযোগী জাত: ব্রি ধান৪৯, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান১০৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৬, বিনাধান-১৬, বিনাধান-১৭। প্রিমিয়াম কোয়ালিটি জাত- ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৯০। বন্যা পরবর্তী নাবিতে চাষযোগ্য জাত- বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৫৪, বিনাশাইল, নাইজারশাইল, গাইঞ্জা, মালশিরাসহ এলাকাভিত্তিক স্থানীয় জাত।
ধান গাছের জীবনচক্রের বিভিন্ন বৃদ্ধি পর্যায় ও ধাপে সঠিক সময়ে কার্যকরী কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধান গাছের জীবনচক্রে বীজের অংকুরোদগম থেকে ধানের পরিপক্ব অবস্থা পর্যন্ত তিনটি বৃদ্ধি পর্যায় অতিক্রম করে থাকে। অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়, প্রজনন পর্যায় এবং পরিপক্ব পর্যায়। অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় ধানের অংকুরোদগম থেকে সর্বোচ্চ কুশি পর্যায় পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই সময়ে গাছের সবচেয়ে বেশি যত্ন প্রয়োজন হয়।
সুস্থ ও সবল চারা তৈরির জন্য পুষ্ট ও সুস্থ বীজ ব্যবহার এবং আদর্শ বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। চারা রোপণের গভীরতা ২-৩ সেন্টিমিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়। এর বেশি গভীরতায় চারা লাগানো হলে কুশির সংখ্যা কম হয় এবং পরে ফলন কমে যায়।
চারার বয়স দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যম মেয়াদি, স্বল্পমেয়াদি এবং নাবী জাতের জন্য যথাক্রমে ২৫-৩০ দিন, ২০-২৫ দিন, ১৫-২০ দিন এবং ৩০-৪৫ দিন।
রোপণ সময়
রোপা আমনের দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদি জাতগুলোর উপযুক্ত রোপণ সময় হচ্ছে পুরো শ্রাবণ মাস (১৫ জুলাই-১৫ আগস্ট)। স্বল্পমেয়াদি জাতগুলোর উপযুক্ত রোপণ সময় হচ্ছে ১০ শ্রাবণ-৩১ শ্রাবণ (২৫ জুলাই-১৫ আগস্ট)। নাবী জাতের চারা সর্বশেষ ৩১ ভাদ্র (১৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত রোপণ করা যাবে এবং ভাদ্র মাসের ১ম থেকে ২য় সপ্তাহ (আগস্টের ৩য় থেকে ৪র্থ সপ্তাহ) পর্যন্ত সরাসরি মূল জমিতে বপন করা যাবে। সম্পূরক সেচ যে কোনো পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাবে খরা হলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে।
দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে: ইউরিয়া ২৩ কেজি, ডিএপি ৮ কেজি, এমওপি ১৪ কেজি, জিপসাম ৯ কেজি। জমি তৈরির শেষ চাষে সমস্ত ডিএপি-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সমান ভাগে তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ৭-১০ দিন পর, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ২৫-৩০ দিন পর এবং ৩য় কিস্তি কাঁইচথোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে: ইউরিয়া ২০ কেজি, ডিএপি ৭ কেজি, এমওপি ১১ কেজি, জিপসাম ৮ কেজি। জমি তৈরির শেষ চাষে ১/৩ অংশ ইউরিয়া এবং সমস্ত ডিএপি/টিএসপি-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া সমানভাগে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম কিস্তি চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর এবং ২য় বা শেষ কিস্তি কাঁইচথোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
নাবীতে রোপণকৃত জাতের ক্ষেত্রে: ইউরিয়া ২৩ কেজি, ডিএপি ৯ কেজি, এমওপি ১৩ কেজি, জিপসাম ৮ কেজি। জমি তৈরির শেষ চাষে ২/৩ অংশ ইউরিয়া এবং সমস্ত ডিএপি-এমওপি-জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া কাঁইচথোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। ব্রি ধান৩২ এবং সুগন্ধিজাত যেমন- ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭ ও ব্রি ধান৩৮ এর ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি ইউরিয়া-ডিএপি-এমওপি-জিপসাম যথাক্রমে ১২-৭-১০-৬ কেজি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। হালকা বুনটের মাটির ক্ষেত্রে এমওপি সার দুই কিস্তিতে (এমওপি সার সমান তিন ভাগে ভাগ করে ২ ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগের সময়) প্রয়োগ করলে সারের কার্যকারিতা বাড়ে এবং রোগ বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়।
চারা রোপণের ৩৫-৪০ দিন পর্যন্ত হাত দিয়ে/নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে/আগাছানাশক ব্যবহার করে জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপণের ৩-৬ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর আগে) এবং পোস্ট ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপণের ৭-২০ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর পর) ব্যবহার করতে হবে। আগাছানাশক প্রয়োগের সময় জমিতে ১-৩ সেন্টিমিটার পানি থাকা দরকার।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
রোপা আমন মৌসুমে ধানের চারা রোপণের পর ৩০ দিন কীটনাশক ব্যবহারে বিরত থাকলে উপকারী পোকামাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে সব মৌসুমে পোকা দমনে কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না কিংবা একবার মাত্র প্রয়োগ করলেই চলে। ধানক্ষেতে ডালপালা পুঁতে দিয়ে ও আলোক ফাঁদ/সোলার লাইট ট্রাপের সাহায্যে মাজরা, পাতা মোড়ানো, সবুজ পাতা ফড়িং ও গান্ধি পোকার আক্রমণ কমানো যায়। জমি থেকে পানি বের করে দিয়ে চুংগি, বাদামি গাছ ফড়িং, সাদা পিঠ গাছ ফড়িং এবং পাতা মাছি পোকার আক্রমণ কমানো যায়। জমিতে পানি দিয়ে শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমণ কমানো যায়। এরপরও পোকার আক্রমণ বেশি হলে মাজরা ও চুংগি পোকা দমনের জন্য কার্টাপ গ্রুপের যেমন- সানটাপ ৫০ পাউডার, রাইডার ৫০ পাউডার জাতীয় কীটনাশক প্রতি বিঘায় ১৮০-১৯০ গ্রাম হারে অথবা যে কোনো অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। বাদামি গাছ ফড়িং ও সাদা পিঠ গাছ ফড়িং দমনের জন্য আইসোপ্রোকার্ব গ্রুপের যেমন- মিপসিন ৭৫ পাউডার, সপসিন ৭৫ পাউডার, প্রতি বিঘায় ১৭৫ গ্রাম হারে প্রয়োগ করতে হবে। পাতা মোড়ানো, চুংগি ও শীষকাটা লেদা পোকা দমনের জন্য কার্বারিল গ্রুপের যেমন-ভিটাব্রিল ৮৫ পাউডার, সেভিন ৮৫ পাউডার প্রতি বিঘায় ২২৮ গ্রাম হারে প্রয়োগ করতে হবে। ধানের পোকা দমনের জন্য সিনথেটিক পাইরিথ্রোয়েড গ্রুপের কীটনাশক যেমন- সাইপারমেথ্রিন, আলফা-সাইপারমেথ্রিন, ল্যামডা-সাইহেলোথ্রিন, ডেলটামেথ্রিন, ফেনভালারেট ব্যবহার করা যাবে না।
রোগ ব্যবস্থাপনা
আমন মৌসুমে গুরুত্বপূর্ণ রোগগুলো হলো- খোলপোড়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, ব্ল্যাস্ট, টুংরো, বাকানি এবং লক্ষ্মীর-গু। খোলপোড়া রোগ ফলিকুর, নেটিভো, স্কোর ইত্যাদি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করে সফলভাবে দমন করা যায়। ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। এ মৌসুমে সুগন্ধি ধানে নেক ব্ল্যাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধানে থোড় আসার শেষ পর্যায় অথবা শীষের মাথা অল্প একটু বের হওয়ার সাথে সাথে ছত্রাকনাশক ট্রুপার অথবা নেটিভো ইত্যাদি অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। বিক্ষিপ্তভাবে দু’একটি গাছে টুংরো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে, আক্রান্ত গাছ তুলে পুঁতে ফেলতে হবে। টুংরো রোগ প্রবণ এলাকায় রোগের বাহক পোকা সবুজ পাতা ফড়িং দমনের জন্য বীজতলায় বীজ বপনের ৮-১০ দিন পর এবং চারা উত্তোলনের ৪-৫ দিন আগে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক যেমন মিপসিন, সপসিন এবং সেভিন প্রয়োগ করতে হবে। লক্ষ্মীর-গু রোগ দমনের ক্ষেত্রে রোপণ সময় এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে ধানের ফুল ফোটা পর্যায় ১৫ অক্টোবরের পরে না যায়। এ ছাড়া ফুল আসা পর্যায়ে প্রোপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন টিল্ট এবং প্রোপেন সাত দিন ব্যবধানে দুইবার প্রয়োগ করতে হবে।