বগুড়ার শিবগঞ্জে তিনশ বছরের প্রাচীন উথলী নবান্ন মেলায় প্রতি বছরের মত এবারও প্রধান আকর্ষণ ছিল বড় বড় সৌখিন মাছ। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে হওয়া একদিনের মেলায় অন্তত কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়েছে।
মাছের মেলাকে ঘিরে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনে ঠাঁসা। জামাই, মেয়ে, নাতি-নাতনি এসে বাড়ি ভরে গেছে। তাদের শীতের নতুন আলু, অন্যান্য শাক-সবজি, শীতের হরেক পিঠা ও মেলার বড় বড় মাছ দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে।
প্রবীণরা জানান, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলী হাটে প্রতিবছরের মত রোববার এক দিনের মাছের মেলা বসে। ৩০০ বছরে প্রাচীন ঐতিহাসিক এ মেলায় এবারও কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ীরা বিশাল আকারের হরেক রকম মাছের পসরা সাজিয়ে শিশির ভেজা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মাছ কেনাবেচা করেন।
এ মেলাকে জামাই মেলাও বলা হয়ে থাকে। এ দিনে উথলী এলাকার শ্বশুরবাড়িতে জামাইদের বড় মাছ কিনে উপস্থিত হতে হয়। আর এটিই দীর্ঘদিনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
তারা আরও বলেন, ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদার বুৎসিংহের কাছে স্থানীয় প্রজারা দাবি করেন এ হাট স্থাপনের। প্রজাদের আবদার রক্ষায় জমিদার প্রায় ৫২ বিঘা জমি হাটের জন্য দান করেন। সেই থেকে বাংলা সনের প্রথম অগ্রহায়ণে উথলী বাজারে নবান্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে নবান্ন উৎসবকে ঘিরে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলী, রথবাড়ী, ছোট ও বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, আকন্দপাড়া, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদেনীপাড়া, বাকশন, গণেশপুর, রহবলসহ প্রায় ২০ গ্রামের পাশাপাশি এ উপজেলা ও জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ কিনতে সৌখিন মানুষ উথলী বাজারে ভিড় করেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, রোববার ভোরবেলা থেকে মেলায় বড় বড় মাছ নিয়ে হাজির হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দিনভর দেড় শতাধিক দোকানে দুই থেকে ২০ কেজি ওজনের বাঘাইড়, বোয়াল, রুই, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, ব্রিগেড কার্পসহ নানা রকমের মাছ বিক্রি হয়েছে মেলায়। বাঘাইড় ১৫০০ টাকা কেজি, বোয়াল ১৪০০ টাকা কেজি, রুই, কাতলা ও চিতল মাছ ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে মাঝারি আকারের মাছ ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।
নবান্নের এ মেলায় মূল আকর্ষণ মাছ ছাড়াও নতুন আলু, কেশর, মিষ্টি আলু, নতুন শাকসবজি, হরেক ধরনের মিষ্টি, রসমালাই, জিলাপি, দুই, মুড়ি, মুড়কি, মাটির তৈজসপত্রের দোকান বসে। শিশুদের জন্য নানা ধরনের খেলনা ও খাবারের দোকান বসেছিল। মেলায় শুধু মাছ নয়; গরু, খাসির গোশতও বিক্রি হয়েছে।
গাবতলী উপজেলার কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী কালাচাঁন বলেন, তিনি তিন লাখ টাকার মাছ এনে ৮০ হাজার টাকা লাভ করেছেন। গত বছরের তুলনায় এবার মাছের দাম একটু বেশি। তবুও ভালো ব্যবসা হয়েছে।
আমতলী গ্রামের মাছ বিক্রেতা আব্দুল বাকী জানান, মেলায় ছোট-বড় মিলে দেড় শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রতিটি মাছ বিক্রেতা ১০ থেকে ১০০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য সেখানে রাত থেকে ২০-২৫টি আড়ত খোলা হয়। সেসব আড়ত থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।
শিবগঞ্জ উপজেলার বেড়াবালা গ্রামের শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, মেলাটি অনেক পুরোনো। মেলাকে ঘিরে আশেপাশের লোকজন কয়েক মাস আগে থেকে আর্থিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন কেনাকাটা করার জন্য। মেলায় মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দেওয়া হয়। প্রতিটি বাড়িতেই মেহমানে ভরপুর থাকে। একেকটি পরিবারের এ মেলায় মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়। যার বাড়িতে যেমন মেহমান আসে, তার বাড়িতে তেমন খরচ হয়। তবে জামাইয়ের বেশি খরচ করতে হয় বলে একে জামাই মেলাও বলা হয়ে থাকে।
বাবু নামে এক ব্যক্তি বলেন, তার বাড়িতে ১৫ জন আত্মীয় এসেছেন। আরও আসার কথা আছে। তিনি ১০ কেজি ওজনের রুই মাছ সাত হাজার টাকায় কিনেছেন। পাশাপাশি নতুন আলু, শাক-সবজি, মিষ্টি, দই, রসমালাই, চিড়া ও মুড়ি কিনেছেন।
সংসারদীঘি গ্রামের বৃদ্ধ রবিন ইসলাম স্মৃতি চারণ করে বলেন, ছোটবেলায় অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম শুক্রবার মসজিদে যাওয়া কোনোভাবেই মিস করিনি। কারণ নবান্ন উৎসবে গ্রামের অনেক মানুষই মসজিদে ক্ষির দিত। নামাজ শেষে মসজিদের উঠানেই কলাপাতায় করে চেটেপুটে খেতাম। তবে এখন তা আর দেখা যায় না। কালের পরিক্রমায় তা আজ হারাতে বসেছে।
শিবগঞ্জ উথলী হাটের ইজারাদার মঞ্জুরুল হক মঞ্জু বলেন, বাংলার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে প্রতিবছর নবান্ন উপলক্ষে সুষ্ঠুভাবে একদিনের এ মেলা হয়ে আসছে। আগে মেলাটি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও গত ৪০ বছর ধরে বড় পরিসরে হচ্ছে। শুধু আশপাশের গ্রামের নয়, পুরো বগুড়া জেলার মানুষ এ মেলায় নবান্নের বাজার করতে আসেন।
অপরদিকে বগুড়ার কাহালু উপজেলাতেও নবান্ন উৎসব উপলক্ষে রোববার স্থানীয় পৌরহাটে মাছের মেলা বসে। সারাদিন মেলায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। উপজেলার প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনে ভরা ছিল।
সূত্র : যুগান্তর