বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির যে সুযোগ দিয়েছে তার পক্ষে নয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। বরং তারা এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ এতে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা দেশের ডিম উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সার্টিফিকেট না নিয়ে ডিম আমদানি করলে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে, যা পোল্ট্রির শিল্পের জন্য ঝুঁকির এবং বিপর্যয় আনতে পারে।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) সচিবালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একশ দিনে কাজের অগ্রগতি জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি তার মন্ত্রণালয়ের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম সাংবাদিকদের তুলে ধরেন।
ডিমের দাম ও আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বন্যার প্রভাবে ডিমের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। একই সঙ্গে কৃষি ফসলও নষ্ট হওয়ায় বাজারে সরবরাহ কম ছিল। ফলে ডিমের চাহিদাও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ছিল। তাই ডিমের দাম নিয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। সেটা এখন নেই।
একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এ সুযোগে মুনাফা লাভের জন্য ডিমের সরবরাহে হস্তক্ষেপ করে। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার যথেষ্ট অভিযান চালিয়েছে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে টিসিবি এবং ট্রাকে করে ন্যায্যমূল্যে ডিম বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে খামারি পর্যায় থেকে সরাসরি বাজারে ডিম আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ডিমের বর্তমান দাম আরও কমানো যাবে যদি উৎপাদন খরচ বিশেষ করে ফিড, একদিনের বাচ্চা এবং বিদ্যুতের দাম কমানো যায়।
তিনি বলেন, এরমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে। তবে প্রান্তিক খামারিদের টিকিয়ে রাখা, দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ ভিরুলেন্ট নিউক্যাসেল ডিজিজ, ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস অথবা নতুন কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব রোধকল্পে ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত বাতিলকরণের লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
ফরিদা আখতার বলেন, পোল্ট্রি সেক্টর সংশ্লিষ্ট নয় এরকম ভুঁইফোড় সংগঠন ও ব্যক্তি দ্বারা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ খাতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রোধে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পোল্ট্রিতে কৃষির হারে বিদ্যুৎ বিল ও ব্যাংকের সুদের হার নির্ধারণের জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে।
বিগত ১০০ দিনে দুটি অধিদপ্তরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজকে ফলপ্রসূ করার জন্য প্রশাসনিক সংস্কার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বদলি, বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের পদায়ন, পদন্নোতির কাজ করা হয়েছে। এই কাজ এখনো চলমান আছে। এসব পরিবর্তন অধিদপ্তরের কার্যক্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং দক্ষতা উন্নয়নে সহায়ক হবে বলে আশা করছি।
আগস্ট মাসের বন্যায় কৃষির পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ১৩টি জেলার ৮৮টি উপজেলায় এক লাখ ৯৭ হাজার ১৬৬টি পুকুর/দিঘি/খামারের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে ১০৭৫১৭ মেট্রিক টন মাছ ও চিংড়ি, পোনা নষ্ট হয়েছে ৪৪ কোটি। মৎস্যখাতে মোট ক্ষতি ১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা।
অন্যদিকে গবাদিপশু (গরু ২.৬০ লাখ, মহিষ ৮ হাজার, ছাগল ৯৩ হাজার, ভেড়া ১০ হাজার, মুরগি ৩৪.২১ লাখ, হাঁস ৪.৬০ লাখ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মারা গেছে ৩৯ হাজার গরু, ১৬ হাজার ছাগল, মুরগি ২১ লাখ, হাঁস ২ লাখ। প্রায় ৭ লাখ ৮২ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট ক্ষতির পরিমাণ টাকার অংকে ৪২৮ কোটি।
বন্যার পর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জরুরি সেবা দিয়েছে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্তের আলোকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, ঋণের কিস্তি স্থগিত করা, মৎস্য ও পশুখাদ্যের আমদানি শুল্ক হাস, দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান, বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রদানের জরুরি ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য যথাক্রমে অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের এনআইডিভিত্তিক স্বয়ংসম্পূর্ণ তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।
অন্যদিকে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশের ডিম ছাড়া নির্বিঘ্ন করতে প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও ১৩ অক্টোবর ২০২৪ থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুত, ক্রয়-বিক্রয়, বাজারজাতকরণ বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি, মোবাইল কোর্ট ও অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৪’ এর আওতায় মোট ২ হাজার ১৬৫টি মোবাইল কোর্ট ও ৯ হাজার ৮০২টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ সব মোবাইল কোর্ট ও অভিযানের মাধ্যমে ৫৪.৮৪ মেট্রিক টন ইলিশ জব্দ, ৬১১ দশমিক ৬৩৮ লাখ মিটার জাল জব্দ, ৩ হাজার ২৫টি মামলা দায়ের, ৭৫ দশমিক ২৭৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায় এবং ২ হাজার ৯ জনকে জেল দেওয়া হয়েছে।
অভিযান চলাকালীন জেলেদের জন্য মানবিক সহায়তার জন্য এবছর মোট ১৪১৬৪ দশমিক ১২৫ টন চাল ৫৬৬৫৬৫টি জেলে পরিবারের মধ্যে বরাদ্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৩৯৬২ দশমিক ১ টন চাল ৫৫৬৫৬০ জন জেলে পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে (বিতরণের হার ৯৯ শতাংশ)। আগামীতে ৪০ কেজি মাসিক ভিজিএফের পরিবর্তে ৫০ কেজি এবং ২৫ কেজি এর পরিবর্তে ৪০ কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং সব জেলে যাতে সরকারের সুবিধা পেতে পারে তার জন্য জেলেদের তালিকা হালনাগাদ করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এবারের মা ইলিশ রক্ষার অভিযান সফল হয়েছে এবং ইলিশের ডিম ফুটার হার ছিল গড়ে ৫৪ শতাংশ, কোথাও ৭০ শতাংশেও বেশি হয়েছে। ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প এর আওতায় বিগত তিন মাসের (আগস্ট- অক্টোবর/২০২৪) মাসে ১৪২৪টি ইলিশ আহরণকারী জেলে পরিবারের মধ্যে ১৪২৪টি বিকল্প আয়ের উপকরণ (এআইজি) বিতরণ এবং ১৮২৫ জন সুফলভোগী ইলিশ জেলেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, বাজারে ইলিশের দাম কেজি প্রতি ১৫০০ টাকা থাকায় এখনো সাধারণ মানুষের চাহিদা মেটাতে পারছে না। ইলিশের দামের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট এবং মধ্য স্বত্বভোগী এবং দাদন ব্যবসাকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করছে।
এছাড়া কৃষি ব্যাংকের মতো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এনবিআরকে অগ্রিম আয়কর কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে খামারিদের বিদ্যুৎ বিলে কৃষির ন্যায় ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি পোল্ট্রিতে কৃষির হারে বিদ্যুৎ বিল ও ব্যাংকের সুদের হার নির্ধারণের জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বিষয়ে তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে এলডিডিপির বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকা ১২৫৩ কোটি টাকা (১০০ মিলিয়ন ডলার) ফেরত দেওয়া হয়েছে। এ অর্থ আমাদের দেশেই থাকবে, ইআরডির মাধ্যমে অন্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যবহার করা যাবে।
তিনি আরও বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে ভেটেরিনারি সাইন্স ও এনিমেল হ্যাজবেন্ডি ডিসিপ্লিনের ডিগ্রিধারী গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বিরাজমান অসন্তোষ দূরীকরণের জন্য একাধিক সভা করা হয়। উভয় ডিগ্রিধারী কর্মকর্তাদের পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে অধিদপ্তরের দুটি পেশাগত ধারাকে একীভূতকরণের উদ্যোগ সফল হয়েছে।