এ কে এম এম হুমায়ুন কবির
কৃষি নেই তো খাদ্য নেই, খাদ্য নেই তো জীবন নেই। খাদ্যনিরাপত্তা ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করতে হলে কৃষিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে হবে। দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের তরুণ হিসেবে ধরা হয়। সে হিসাবে তরুণ জনগোষ্ঠীর হার ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ, সংখ্যায় যা পৌনে ৫ কোটি।
সম্প্রতি তরুণদের কৃষিতে সম্পৃক্ততার হার বেড়েছে। তরুণদের প্রায় ১৭ থেকে ২০ শতাংশ কৃষি বা খামারে কাজ করেন। এই সংখ্যা অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পার। গ্রামীণ তরুণদের কৃষিতে সম্পৃক্ততা তুলনামূলকভাবে বেশি। সম্প্রতি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কৃষি ও খামারে সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ বাড়ছে। তাঁরা দেশের কৃষি খাতের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
তরুণেরা, বিশেষত শিক্ষিত তরুণেরা পুরো বাংলাদেশের কৃষির চিত্র পাল্টে দিচ্ছেন। যেমন দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের তরুণেরা সমতল ভূমিতে মালটা চাষে সফল হয়েছেন। ঢাকার অদূরে সাভার ও কালিয়াকৈরে সবজি চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছেন তরুণেরা। রাজশাহীতে আম আর ধানের চাষে তাঁরা সূচনা করেছেন নতুন দিগন্তের।
তরুণদের কৃষিতে সম্পৃক্ততায় কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো হলো—১. সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা সংস্কৃতির প্রসারের ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কৃষির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, ডিজিটাল মার্কেটিং ও কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তরুণদের এই খাতে আগ্রহী করে তুলেছে। ২. তরুণ প্রজন্ম কৃষিকে এখন আর শুধু প্রথাগত পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। তাঁরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষির উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, তরুণেরা স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে ফসল উৎপাদন, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ ও বাজারজাতকরণ–সম্পর্কিত তথ্য সহজলভ্য করে তুলছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের অটোমেশন টেকনোলজি যেমন ড্রোন, স্যাটেলাইট ইমেজারি ও সেন্সর ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং খরচ কমানো সম্ভব হচ্ছে। এই ধরনের উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহার তরুণদের কৃষিতে আকৃষ্ট করছে। ৩. কৃষি খাতে তরুণ উদ্যোক্তারা কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং ও রপ্তানির মতো খাতগুলোতে বিনিয়োগ করছেন। অনেকে আবার খামার ব্যবস্থাপনা, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন ও ডেইরি ফার্মের মতো উদ্যোগ নিচ্ছেন। ৪. কৃষিতে তরুণ নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে নারীরা কৃষির প্রতিটি ধাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তবে তরুণ নারীদের কৃষিতে সম্পৃক্ততা ক্রমবর্ধমান। নারী উদ্যোক্তারা কৃষিতে সাফল্য অর্জন করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি অন্য নারীদেরও উদ্বুদ্ধ করছেন।
যদি আমরা তরুণদের কৃষিতে আরও সম্পৃক্ত করতে চাই, তাহলে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগ হলো—১. তরুণদের কৃষিপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে দক্ষ করে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা। ২. তরুণ উদ্যোক্তাদের কৃষি খাতে বিনিয়োগের জন্য ঋণ বা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। এর ফলে তরুণেরা কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, কৃষিপণ্য রপ্তানি ও খামার ব্যবস্থাপনায় নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে পারবে। ৩. সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে তরুণ কৃষকেরা সহজেই কৃষিবিষয়ক তথ্য, বাজারদর ও বিপণন কৌশল সম্পর্কে জানতে পারবে। ৪. কৃষিপণ্য সরাসরি বাজারে বিক্রির সুযোগ তৈরি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানো। ৫. কৃষিশিক্ষার মানোন্নয়ন ও কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যা তরুণদের কৃষিতে আগ্রহী করবে।
তরুণেরা দেশের ভবিষ্যৎ। একই কারণে তাঁরা কৃষি ও গ্রামীণ শিল্পেরও ভবিষ্যৎ। কৃষিতে তরুণদের সম্পৃক্ততা দেশের খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, কৃষিপণ্য রপ্তানি, কৃষি খাতের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফলে আলোচিত বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মহলের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স)
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।