মাছ চাষে ভরবো দেশ, গড়বো সোনার বাংলাদেশ” মাছ চাষে মানসম্মত পোনার ভূমিকা অপরিসীম। হ্যাচারি থেকে রেণু পোনা সংগ্রহ করে তা লালন পালন করার জন্য পুকুরে রেখে ৫-১০ সে.মি. বা ৭-১২ সে.মি. পর্যন্ত বড় করে চাষের পুকুরে ছাড়ার পদ্ধতিকেই রেণু পোনা চাষ পদ্ধতি বলে। মাছ চাষের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুস্থ্য সবল উন্নতজাতের পোনা সরবরাহ নিশ্চিত করা।
মাছের গুণগতমানের পোনা উৎপাদনে সাফল্যের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কুমিল্লা জেলার, সদর দক্ষিণ উপজেলার ধরুনিবন্ধ গ্রামের মো.নুরুল আমিন। তিনি কর্মজীবনের শুরু থেকেই একজন কৃষক। কৃষিকাজ করেই দৈনন্দিন জীবন যাপন করতেন। তারপর তিনি কৃষিকাজের পাশাপাশি হ্যাচারি থেকে রেণু কিনে তা পাতিলে করে কাঁধে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন। ২০০৯ সালে একটি পুকুর লিজ নেন এবং তাতে তিনি কার্প জাতীয় মাছের রেণুর মিশ্র চাষ শুরু করেন। তিনি এই রেণু সংগ্রহ করেন জাঙ্গালিয়া মৎস্যবীজ উৎপাদন খামার থেকে। রেণু ছাড়ার আগে তিনি পুকুর প্রস্তুত করেন। তিনি ফাল্গুন মাসে পুকুর সেচে চৈত্র মাস পর্যন্ত পুকুরটিকে শুকিয়ে নেন। পুকুরটিকে ভালভাবে শুকানোর পর প্রতি শতকে ১/২ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করেন।
চুন দেয়ার ৪-৫ দিন পর পুকুরে পানি দেন। পানি দেয়ার পর তিনি জাল টেনে হাঁস পোকা পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর তিনি প্রতি শতকে ৩-৪ ফুট গভীরতার ৬০ শতাংশ পুকুরে ১০০ গ্রাম সুমিথিয়ন দেন। সুমিথিয়ন দেয়ার ২৪ ঘণ্টা পর পুকুরে রেণু ছাড়েন। সুমিথিয়ন দেয়ার পরও যদি হাঁস ,পোকা না মারা যায় তাহলে তিনি পুকুরে কেরোসিন ব্যবহার করেন। কেরোসিনটা তিনি পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে ছিটিয়ে দেন , যা বাতাসে উত্তরে নিয়ে আসে তাতে বাকি হাঁস পোকাও মারা যায়। রেণু ছাড়ার ১ দিন পর তিনি খাবার দেন। ১ কেজি রেণুকে ৪-৫ টা সিদ্ধ ডিমের কুসুম গুলিয়ে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ছেঁকে তারপর সারা পুকুরে ছিটিয়ে দেন। পরের দিন তিনি নিজে বাটি দিয়ে রেণু কাটাই করে দেখেন রেণুর খাদ্য থলিতে খাদ্য আছে কিনা। তারপর তিনি ১ কেজি ময়দা ২৫০ গ্রাম সরিষার তৈল দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে একটা পাত্রে নিয়ে পানি দিয়ে একটা তরল খাদ্য তৈরী করেন।
এই খাদ্য তিনি পুকুরের চার কোনা থেকে ছেড়ে দেন যা ভেসে সারা পুকুরে থাকে। সরিষার তৈল দেয়ার কারণে খাদ্যটা ভাসমান থাকে যার কারণে রেণুটা পরেও খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। দৈনিক তিনি ১ বার করে টানা ৩ দিন এই খাবার প্রয়োগ করেন। তিনি খাদ্য হিসেবে খৈল, ভুসিও ব্যবহার করেন। খৈল আগের দিন ভিজিয়ে রেখে ১.৫ একরের ১ টি পুকুরে ২ কেজি রেণুর জন্য ৫ কেজি খৈল ২ দিন দেন। এভাবে রেণু বড় হওয়ার সাথে সাথে খাবারের পরিমানও বাড়তে থাকে। তবে তিনি শীতকালে খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেন। কারণ মাছ শীতকালে খাদ্য কম গ্রহণ করে। তিনি ১ টি পুকুর লিজ নিয়ে রেণু পোনা চাষ শুরু করে এখন বর্তমানে ১০ টি পুকুর লিজ নিয়ে রেণু পোনা চাষ করছেন।
রেণু চাষের সময় এই পোনার বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। লালদাগ রোগ, লেজ পঁচা রোগ দেখা দেয়। শীতকালে ক্ষতরোগটা বেশি দেখা যায়। এসব রোগের প্রতিকারের তিনি ১ শতকে ২.৫ ফুট গভীরতায় ২.৫ কেজিব একটু কম চুন প্রয়োগ করেন। তাছাড়া তিনি প্রতি শতকে ২.৫ ফুট গভীরতায় ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করেন। রৌদ্র উঠলে লবণ প্রয়োগ করে বিকালে জাল টেনে নেন। আর চুন প্রয়োগ করার আগে গোলানো চুনটা ছেকে নেন তারপর প্রয়োগ করেন
তাছাড়াও যদি পোনার অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয় তখন তিনি পুকুরে অক্সিজেন বাড়ানোর জন্য ঔষুধ ব্যবহার না করে পুকুরে পাম্প মেশিন লাগিয়ে পানির ঢেউ তৈরী করেন।
চাষকালে তার সমস্যা হলে তিনি উপজেলা এবং জেলা মৎস্য দপ্তরে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে স্যাররা এসে পর্যবেক্ষণ করে যান এবং পরামর্শ প্রদান করেন । তিনি রেণু চাষ ছাড়াও ২০১৩ সালে চিংড়ি চাষ করেন। সেখানে ব্যাপকভাবে লাভবান হলেও বন্যার কারণে পরে ক্ষতিগ্রস্থ হন এবং চিংড়ি চাষ ছেড়ে দেন। ১ একরের ১ টি পুকুরে ৪৫ দিনে তার ব্যয় হিসাব বাদ দিয়ে বৎসরে ৫০ হাজার টাকা লাভ আসে।
তার পরিবারে তার স্ত্রী, দুই ছেলে আছে। বড় ছেলেকে এই ব্যবসার লাভের অংশ দিয়ে দুটো দোকান নিয়ে দেন এবং ছোট ছেলেকে অনার্স শেষ করে একটা চাকরির পাশাপাশি মাস্টার্স পড়াচ্ছেন। শুরুতে আর্থিকভাকে তিনি দূর্বল থাকলেও বর্তমানে তিনি আর্থিকভাবে অনেক স্বচ্ছল।
তিনি রেণু পোনা চাষ করে ২০১২ সালে পোনা উৎপাদন শুভেচ্ছা স্মারক লাভ করেন। ২০১৩ সালে মাছের গুণগত মানের পোনা উৎপাদনে সাফল্যের স্বীকৃতি লাভ করেন জেলা মৎস্য দপ্তর, কুমিল্লা থেকে এবং ২০১৯ সালেও তিনি পোনা চাষে সম্মাননা স্মারক লাভ করেন উপজেলা মৎস্য দপ্তর, সদর দক্ষিণ, কুমিল্লা।
সর্বশেষ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, আঞ্চলিক অফিস,কুমিল্লা থেকে মাছ চাষের বিভিন্ন লিফলেট বিতরণ করা হয় এবং তথ্য দপ্তরের পরিচিতি দেয়া হয়। চাষ সম্পর্কিত যেকোনো লিফলেট পেতে তথ্য দপ্তরের ” মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য ভান্ডার ” অ্যাপসটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে বলা হয়। সেই সাথে আমাদের সেবাটি ভালো লাগলে অ্যাপস এর কমেন্ট এ লিখতে বলা হয়।
“রূপালি মৎস্য দিচ্ছে ডাক, দারিদ্রতা মুছে যাক” মাছ চাষের মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়া সম্ভব।
মাছ আমাদের অমূল্য প্রাণিজ জাতীয় সম্পদ। নিজেদের একান্ত প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং বিজ্ঞজনদের পরামর্শ গ্রহণ করলে মাছ চাষে কম খরচে বেশি লাভবান হওয়া যায়। মাছ দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারব। রূপালি সম্পদে দেশকে টইটুম্বর করতে পারব। আমাদের পারিবারিক সামান্য জলসীমা যেন আমরা খালি না রেখে পরিকল্পিত উপায়ে মাছ চাষ করি। মাছের অনেক চাহিদা থাকার কারণে মাছ চাষ করে ভালো আয় করা সম্ভব। “কার্প জাতীয় মাছের করলে চাষ, ফলন পাবো বারো মাস”।