হেমন্তের ভোরে গ্রামীণ জনপদের মেঠোপথে হাঁটলেই চোখে পড়ে টিন-কাঠের তৈরি ছোট ছোট ঘরবাড়ি। সেখান থেকেই ভেসে আসে মোরগ-মুরগির কলকাকলি। প্রতিটি বাড়িতে মুরগি পালন, তাদের পরিচর্যা এবং ডিমের বাজারজাত নিয়ে ব্যস্ত সবাই।
- এই চিত্রটি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নোয়াদ্দা গ্রামের। এখানেই একজন সফল নারী উদ্যোক্তা শারমিন আক্তার, যিনি ফাউমি মুরগি পালনে ভিন্ন এক নজির স্থাপন করেছেন।
২০১৯ সালে প্রবাসী ভাইদের পরামর্শে শারমিন আক্তার মুরগি পালনের কার্যক্রম শুরু করেন। তখন তিনি বগুড়া থেকে ৩০০ পিস মিসরীয় ফাউমি মুরগির বাচ্চা কিনে এনে খামার গড়ে তোলেন। প্রথমদিকে ছোটখাটো খামার ছিল। কিন্তু এখন তার খামারে ১ হাজার ২০০ মুরগি রয়েছে। প্রতিদিন উৎপাদিত হয় ৯০০ পিস ডিম। ফাউমি মুরগির ডিমগুলো বড় এবং ছোট সাইজের হয়, আর সেগুলো বিক্রির পর মাঝারি সাইজের ডিমগুলো ইনকিউবেটর মেশিনে রেখে নতুন বাচ্চা ফুটানো হয়।
শারমিনের খামারের সফলতার রহস্য হলো তার ভাই আনোয়ার হোসেনের সহায়তা। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলেও, আনোয়ার যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন তিনি তার বোন শারমিনের খামারের দেখাশোনা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চার ভাই ও চার বোন পারিবারিকভাবে এই খামারটি পরিচালনা করি। শারমিনের কাছ থেকে লালন-পালনের কৌশল শিখে এখন আমি সার্বক্ষণিকভাবে এখানে কাজ করছি।’
শারমিনের খামারের সাফল্যের পেছনে রয়েছে তার অবিচল প্রচেষ্টা এবং দক্ষতা। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে একটি খামার দিয়েছিলাম। এখন আমার খামারের সংখ্যা বেড়ে পাঁচটি হয়েছে।’ তার খামারে এখন মুরগির পাশাপাশি ডিম ও বাচ্চা বিক্রিও শুরু হয়েছে। মুরগি থেকে উৎপাদিত ডিমের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, আর এর মাধ্যমে পরিবারের আয়ের পথ উন্মোচিত হয়েছে।
ফাউমি মুরগি পালন করতে গিয়ে শারমিন আক্তার যে বড় সফলতা পেয়েছেন, তার কারণ হলো মুরগির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। তিনি জানান, ‘ফাউমি মুরগি খুব কমই রোগে আক্রান্ত হয়। তাদের জন্য বিশেষ করে ভ্যাকসিনের প্রয়োজন পড়ে না। মুরগিগুলোকে তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়, দানাদার খাবারের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাবারও থাকে।’ এতে করে মুরগির বৃদ্ধি দ্রুত হয় এবং রোগবালাইয়ের ঝুঁকি কম থাকে।
বর্তমানে শারমিন আক্তারের খামার থেকে মুরগি, ডিম ও বাচ্চার চাহিদা বাড়ছে স্থানীয় বাজারে। প্রত্যেক পিস বাচ্চা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তার খামারের মুরগির ডিম স্থানীয়ভাবে খুব জনপ্রিয়। শারমিন জানান, ‘বাজারে ফাউমি মুরগি ও ডিমের চাহিদা অনেক বেশি। শেড বাড়িয়ে ভবিষ্যতে উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, যদি প্রত্যেক বাড়িতে একটি খামার স্থাপিত হয়, তবে দেশের উন্নতির পাশাপাশি পরিবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব।’
শারমিনের সফলতার পেছনে রয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের সার্বক্ষণিক সহায়তা।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জ প্রাণিসম্পদে সমৃদ্ধ। এখানে অনেক গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি উৎপাদন হয়। এতে শারমিন আক্তার একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তার উদাহরণ অনুসরণ করে এখন অনেক নতুন উদ্যোক্তা মুরগি পালন শুরু করেছেন। প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে আমরা তাদের চিকিৎসাসেবা, কৃমিনাশক ও সরকারি মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করছি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়ানো হচ্ছে।’
ডা. নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘শারমিন আক্তারের মতো উদ্যোক্তা সৃষ্টি হলে মুন্সীগঞ্জের মাংস ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং জেলা কৃষিতে এক নতুন যুগের সূচনা হবে।
সূত্র : খবরের কাগজ