প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২৩ এএম
চলনবিল অঞ্চলে শুঁটকি উৎপাদনের চাতালগুলোতে নারীরা পুরুষের সমান পরিশ্রম করলেও তাদের মজুরি অর্ধেক। স্থানীয় নারী শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, পুরুষদের ৪০০-৫০০ টাকা মজুরির বিপরীতে তারা মাত্র ২০০ টাকা পান। এ বিষয়ে মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, নারী শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে চাতালমালিকদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। চলনবিলের দেশীয় মাছের শুঁটকি দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি ও বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। তবে মজুরিবৈষম্য নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
চলনবিলের মিঠা পানির দেশীয় মাছ দিয়ে শুঁটকি উৎপাদন হয়। প্রতিবছর অক্টোবর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলতে থাকে। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ ও শাহজাদপুর উপজেলার চলনবিল এলাকার শতাধিক শুঁটকির চাতালে চলে শুঁটকি উৎপাদন। এখানে কোনো প্রকার রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না। শুধু লবণ মিশিয়ে মাছ সূর্যের আলোয় শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়।
এ অঞ্চলের শুঁটকির মান অত্যন্ত উন্নত। দেশের বিভিন্ন স্থানে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে, নীলফামারী, সৈয়দপুর, রংপুর, ঢাকা ও অন্যান্য শহরে এ শুঁটকি বিক্রি হয়। এ ছাড়া, স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ভারত, মালয়েশিয়াসহ বিদেশেও রপ্তানি করা হয় শুঁটকি। শুঁটকি উৎপাদনের এই বিশাল কার্যক্রমে এখন শতাধিক শ্রমিক কর্মরত, যাদের অধিকাংশই নারী। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব চাতালে মাছ কাটা, পরিষ্কার করা, ধোয়া ও রোদে শুকানোর কাজ করেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা।
এ শ্রমের মধ্যে একটি বড় বৈষম্য দেখা যায়, তা হলো পুরুষ ও নারীর মজুরির পার্থক্য। অভিযোগ উঠছে, নারীরা পুরুষের সমান পরিশ্রম করেন, তবুও তাদের মজুরি পুরুষের অর্ধেক। এই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক নারী শ্রমিক।
তাড়াশ উপজেলার ললুয়াকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মাজেদা খাতুন বলেন, ‘স্বামী বেঁচে থাকলেও তিনি সংসারের কোনো খরচ দেন না। গত ১০ বছর ধরে শুঁটকির চাতালে কাজ করছি। দিনের শেষে যা মজুরি পাই, তা দিয়ে সংসার চালাতে হয়।’ তার মতে, নারীদের প্রাপ্য মজুরি ঠিকভাবে দেওয়া হয় না, তাদের শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত।
অন্যদিকে তাড়াশের নওগাঁ ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা ছকিনা খাতুন বলেন, ‘আমার সংসারের সবাই আমার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। আমার স্বামী মানসিক প্রতিবন্ধী, তিনি কোনো কাজ করেন না। সন্তানের পড়াশোনার খরচও আমাকে দিতে হয়। একই কাজ করার পরও পুরুষরা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি পায়, আর আমি ২০০ টাকা পাই। বর্তমান বাজারদরে ২০০ টাকায় কিছুই কেনা যায় না।’
উল্লাপাড়ার বড় পাঙ্গাসী গ্রামের বাসিন্দা জয়ন্তী দাস বলেন, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুঁটকির চাতালে কাজ করি। কিন্তু আমাকে যে মজুরি দেওয়া হয়, তা অত্যন্ত কম। পুরুষ শ্রমিকরা একই কাজ করে ৪০০ টাকা পায়, আর আমি পাই ২০০ টাকা।’ তিনি জানান, নারী শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর জন্য বারবার মালিকদের কাছে দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু তারা তার কথা তেমন গুরুত্ব দেননি।
এ ছাড়া নারী শ্রমিক শাহিনুর বেগম বলেন, ‘পরিবারের অভাবের কারণে চাতালে কাজ করি। সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় মালিক ২০০ টাকা দেন। পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় আমরা অর্ধেক মজুরি পেয়ে অসহায় বোধ করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মজুরি বাড়ানোর জন্য মালিকদের কাছে বহুবার বলেছি। কিন্তু তারা আমাদের কথা আমলে নেননি।’
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, শুঁটকির দাম মাছের আকার ও মান অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। পাইকারি বাজারে শুঁটকির দাম ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ভোক্তা পর্যায়ে শুঁটকির দাম আরও বেশি হয়। বিশেষ করে বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন শুঁটকির দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। যেমন- বোয়ালের শুঁটকি ২ হাজার টাকা, বড় শোল ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, মাঝারি টাকি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, ছোট টাকি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, চিংড়ি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, বাইম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং বিভিন্ন আকারের পুঁটির শুঁটকি ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়।
উল্লাপাড়ার বড় পাঙ্গাসী গ্রামের চাতালমালিক বায়েজিত হোসেন জানান, কয়েক বছর আগে শুঁটকি উৎপাদন অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এখন উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলে বরাবরই নারী শ্রমিকদের মজুরি কম ছিল। এখন তারা মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে। তারা যদি কাজ অনুযায়ী উপযুক্ত মজুরি পায়, তাহলে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে।’
মৎস্য উৎপাদনকারী মোতাহার হোসেন বলেন, ‘কিছু বছর ধরে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় শুঁটকির উৎপাদনে লোকসান হচ্ছে। বছরে ছয় মাস এই কাজ করা সম্ভব হয়। যদি মাছের পরিমাণ বাড়ে, তবে নারী শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হবে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহীনুর রহমান বলেন, ‘চলনবিলের দেশি মাছ সুস্বাদু ও মানসম্পন্ন হওয়ায় বিদেশে শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর ৩১৭ টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছে। এ বছর প্রায় ৩৫০ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নারী শ্রমিকদের মজুরি কম দেওয়ার বিষয়টি জানার পর উপজেলা মৎস্য বিভাগ চাতালমালিকদের সঙ্গে আলোচনা করবে। নারীদের মজুরি বৃদ্ধির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’