শেখ সিরাজউদ্দৌলা লিংকন, কয়রা (খুলনা) থেকে : পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রের অন্তর্গত নিষিদ্ধ খাল ও নদনদীতে অবাধে মা মাছ ও কাঁকড়া শিকার করছে প্রায় তিন শতাধিক জেলে। এসব জেলেরা ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে মাছ ও কাঁকড়া শিকারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ বনাঞ্চলের গহিনে। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট অভয়ারণ্যকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে বন আইন উপেক্ষা করে মাছ ও কাঁকড়া শিকার অব্যাহত রেখেছে জেলে নামধারী দুর্বৃত্তরা। এভাবে নিষিদ্ধ বনাঞ্চলের নদনদীতে অবাধে মা মাছ ও রেণুপোনা ডিম ধ্বংস করতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
জেলে ও বাওয়ালিদের সূত্রে জানা যায়, নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রের কতিপয় কর্মকর্তা কর্মচারীর সঙ্গে গোন চুক্তিতে (৭ দিনে এক গোন) নৌকা প্রতি ফাঁস জাল ৭ হাজার টাকা, কাঁকড়া ৩ হাজার টাকা, চরপাটা জালে ১০ হাজার টাকা ও কাটি জালে ৫ হাজার টাকা ও পারশে পোনা আহরণ প্রতি বিশ হাজার টাকা দিতে হয়। এতে নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী গোনে প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে জেলে নামধারী দুর্বৃত্তদের সুন্দরবনের এসব অভয়ারণ্য এলাকায় অবাধে মাছ ও পোনা ধরার সুযোগ করে দেন। প্রতিটি জেলে নৌকায় ৫০ ওয়াটের সৌরবিদ্যুৎসহ দুই-তিনটা মোবাইল ফোন থাকে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসার আগেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জেলেদের সতর্ক করা হলে তারা তাৎক্ষণিক খালের আগা অথবা গহীন বনে ঢুকে পড়েন। যে কারণে নীলকোমল অভয়ারণ্য এলাকার নিষিদ্ধ বনাঞ্চলের নদী ও খালে প্রায় সারা বছর ধরে অবাধে মাছ ও কাঁকড়া ধরা অব্যাহত থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলেরা জানান, নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রের অধীন বঙ্গবন্ধুর চর, বুন্দর মুখ, গোলাকাটা, মোরা খাল, কোলাতলা, দীপচর, বালিরগাঙ, ছিচ খালির মুখ, কোদাল কাটার ভারানিসহ আশপাশের বনাঞ্চলের নিষিদ্ধ খাল ও নদীতে অবাধে মাছ ও কাঁকড়া শিকার অব্যাহত রয়েছে। নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রের সম্মুখে আব্দুল্লার খালে কয়েকজন জেলে প্রায় সারা বছর কাঁকড়া শিকার করছে। এছাড়া কেওড়া সুতি খালে চরপাটা জাল কাটিজালসহ কাঁকড়া ধরা চলছে। চান্দা বুনিয়ার খালে চরপাটা জাল, ফাঁস জাল ও কাটিজালে অবাধে মাছ ও কাঁকড়া শিকার করছে জেলেরা। গোণ চুক্তিতে প্রতিদিন আলোর কল থেকে আসা প্রায় ৬০-৭০টি ইঞ্জিন চালিত ট্রলার প্রতি ১০ হাজার টাকা গুন চুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর চর, পুটনি, বালির গাঙসহ কয়েকটি নদী ও খালে নিষিদ্ধ বেহেন্দী জালে মাছ ধরছে।
এছাড়া আমড়াতলার ভারানি গোলাকাটা, কোলাতলা, সিচ খালি খাল, ছিচখালি চরের খাল, ছিচখালি লম্বাখালে মাছ ও কাকড়া শিকার অব্যাহত রয়েছে। বুন্দুয় প্রায় শতাধিক কাঁকড়া জেলে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর চরে প্রায় ১০/১২টি ইঞ্জিনচালিত ট্রলারসহ ডিঙ্গি নৌকার মাধ্যমে ফাঁস জাল ও চরপাটা জালে মাছ ধরা হচ্ছে। এমনকি চুক্তিতে নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রের যাত্রী ছাউনির পূর্ব মাথায় বাতিঘরে কয়রা এলাকার দুইজন জেলে রাত্রি যাপন করে। সারাদিন এই জেলে সুন্দর বনে খালপাটা কাটিজাল ফাঁস জালে মাছ ধরে রাতে এসে বাতিঘরে রাত যাপন করে। গোন চুক্তিতে ট্রলার প্রতি বিশ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে পাঁচটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলারের মাধ্যমে নিষিদ্ধ জালে পারশে পোনা আহরণ করছে। খুলনার পাইকগাছার ২টি চালনা এলাকার একটি ও কয়রা এলাকার দুইটি ট্রলারে নির্বিচারে পারশে মাছের এই রেণুপোনা আহরণ করছে। জেলেরা এক প্রজাতির পোনা ধরতে গিয়ে প্রতিদিন শতাধিক প্রজাতির কোটি কোটি বনজ প্রাণি ও ডিম ধ্বংস করছে। জানা গেছে এই পারশে পোনা আহরণে ইতোমধ্যে শুধুমাত্র কয়রা এলাকারই আরো ৩০টি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার সুন্দরবনে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। যে কোনো মুহূর্তে এরা সুন্দরবনের নিষিদ্ধ বনাঞ্চলে ঢুকে নির্বিচারে পোনা নিধন করবে। এভাবে নিষিদ্ধ বনাঞ্চলের নদনদীতে অবাধে মা মাছ রেনুপোনা ডিম ধ্বংস করতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার ২০০৩ সালে এসব এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেন। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও মাছ প্রজননের জন্য এসব নদনদী ও খাল এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাছ ধরা ও কাঠকাটাসহ সব ধরনের বনজ দ্রব্য আহরণ নিষিদ্ধ করে সরকার। বঙ্গোপসাগর থেকে বয়ে আসা এসব খাল ও নদনদীতে বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ এসে ডিম ছাড়ে। এ কারণে সুন্দরবনের অন্যান্য নদনদী ও খালের তুলনায় এসব জায়গায় বেশি মাছ পাওয়া যায়। ফলে লোভের বশবর্তী হয়ে জেলে নামধারী দুর্বৃত্তরা অল্প সময়ের মধ্যে এসব মা মাছ ও রেণুপোনা সমূলে বিনষ্ট করছে। চলতি শীত মৌসুমের প্রায় ৫/৬ মাস নির্বিচারে মা মাছসহ পোনা ধ্বংস অব্যাহত থাকবে। এতে করে মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রগুলো ধ্বংস হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
জানতে চাইলে সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন একটি বিশাল এরিয়া। হয়তো জেলেরা অভয়ারণ্য এলাকা থেকে মাছ শিকার করতে পারে। তবে আমরা যখন ইনফরমেশন পাই, তখন অভিযান চালিয়ে নৌকাসহ জেলেদের আটক করে আনি। আজও দুটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে। সবাই মিলে সহযোগিতা করলে এসব নামধারী জেলেদের থামানো সম্ভব হবে।
সূএ : ভোরের কাগজ