পস্নাবনভূমিতে মাছ চাষে বাংলাদেশের মডেল কুমিলস্নার দাউদকান্দি উপজেলা। একই জমিতে মাছ ও ধান চাষ করা এ মডেলটি সারা দেশে প্রশংসিত হয়েছে। দাউদকান্দির বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে শতাধিক মৎস্য প্রকল্প। এসব প্রকল্পে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থান। সমাজবদ্ধভাবে মাছ চাষের উদ্যোক্তাদের রয়েছে কঠোর পরিকল্পনা ও পরিশ্রম। এসব উদ্যোক্তার একজন আলী আহম্মদে মিয়াজী।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছেড়ে গ্রামের মেঠো পথ পেরিয়ে যখন দাউদকান্দির বেকিনগর পৌঁছাই তখন সবেমাত্র ভোরের নরম সোনামাখা সদ্য প্রস্ফটিত প্রথম আলো, পস্নাবনভূমিতে খেলায় মত্ত জল-জাল-জেলেদের সঙ্গে।
প্রকৃতির সব রং ঢেলে দিয়ে এখানে তৈরি করেছে হৃদয়ছোঁয়া জল-রংয়ের ভূবন মোহনী ক্যানভাস। ছয় মাস সোনাফলা ধান আর একই জায়গায় বাকি ছয় মাস রুপালি মাছের চাষ। বাংলার সৌন্দর্যে ভরা শীতল গ্রামের ঐক্যবদ্ধ মানুষের পস্নাবনভূমিতে সমাজবদ্ধ হয়ে মাছ চাষের অপরূপ বিমুগ্ধ রূপায়ণ এখন এই জনপদে।
ভোরের সূর্য পস্নাবনের জলে উঁকি দিতেই ঘুমন্ত জনপদ আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। রুপালি মাছ চাষিদের চোখে রঙিন ঝিলিক, কর্মব্যস্ত মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক- সব মিলে যেন তৈরি করেছে আলাদা এক ক্যানভাস। এ যেন ভাত-মাছের ১৬ আনাই বাঙালিয়ানা। যে জমি দেয় ভাত, সে জমিই আবার হয়ে ওঠে অফুরন্ত মাছের ভান্ডার। ইতিমধ্যেই ‘দাউদকান্দি মডেল’ নামে খ্যাত পস্নাবনভূমিতে মাছ চাষ সারা দেশেতো বটেই আন্তর্জাতিকভাবেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যা ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ায় অনুকরণীয় হয়ে উঠছে। প্রায়ই বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিদল আসে দাউদকান্দিতে গড়ে ওঠা পস্নাবনভূমিতে মৎস্য চাষ প্রকল্পগুলো দেখতে।
দাউদকান্দি উপজেলায় বাৎসরিক মাছের চাহিদা ৬ হাজার ৯৮৭ টন। বিপরীতে গত বছর উৎপাদন হয় ৪৫ হাজার ৩৫৯ টন। এর মধ্যে পস্নাবনভূমির জমি থেকে মাছ পাওয়া যায় প্রায় ৪০ হাজার টন। যা স্থানীয় চাহিদার চেয়ে প্রায় ৩৯ হাজার ৩৭২ টন বেশি।
তিন দশক আগে এখানকার ধানুয়াখোলা গ্রামের সুনীল বাবু যে স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছিলেন আজ সেই বীজ ডালপালা ছড়িয়ে মহীরুহ হয়ে উঠেছে। যেখানে চিত্রায়ণ হচ্ছে পস্নাবনভূমিতে মাছ উৎপাদনে, দেশসেরা ১১৬টি জলাশয়ে মাছ আর জালের শৈল্পিক মহাকাব্য।
সেই কাব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রঙিন স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়া গ্রামীণ জনপদের অন্যতম সফল মৎস্য চাষি আলী আহম্মেদ মিয়াজী। তিন হাজার ছয়শ’ বিঘা জমিতে যার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে স্বপ্নের জাল। আটটি মৎস্য প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। নম্র-বিনয়ী আলী আহম্মদের সঙ্গে কাজের ফাঁকেই জমে ওঠে আড্ডা।
পড়াশোনায় মাধ্যমিক গন্ডি পেরিয়েই আলী আহম্মেদ জড়িয়ে পড়েন পস্নাবনভূমিতে মাছ চাষে। মাঝে উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমান প্রবাসে। কিন্তু যার সখ্য জল আর জালের সঙ্গে সে তো আর বিদেশে থিতু হতে পারেন না। বছর তিনেক পর দেশে ফিরেই আবার শুরু হয় তার জল-জাল নিয়ে লেখা পান্ডুলিপির নাট্যরূপ। সরাসরি চারশ’ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার আটটি প্রকল্পে ঠোঁটের কোণে মৃদ হাসি ঝুলিয়ে পরিতৃপ্তির সঙ্গে বললেন আলী আহম্মেদ মিয়াজী।
উপজেলা-জেলায় সেরা- সরকারিভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত মৎস্য উদ্যোক্তা, জাতীয়ভাবে মাছ উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পেরে গর্বিত মনে করেন তিনি নিজেকে। ১১৬টি মৎস্য প্রকল্পে লক্ষাধিক মানুষের অর্থ উপার্জনের এবং এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ নানাভাবেই হচ্ছেন যার সুফলভোগী যোগ করেন আলী আহম্মেদ মিয়াজী।
প্রায় দেড়শ’ গ্রামে লক্ষাধিক মানুষের সচ্ছল হওয়ার গল্পে যতই চোখ কপালে উঠুক, পস্নাবনভূমিতে মাছ চাষে ব্যস্ত জনপদে অনেকাংশেই কমে এসেছে বেকারত্ব। নেই মাদকসেবীদের উপদ্রব। আয়রোজগারে ব্যস্ত মানুষের প্রয়োজন হয় না চুরি-ছিনতাইয়ের মতো সমাজবিরোধী কাজে জড়িয়ে পরার। সামাজিকভাবে মাছ চাষ, সমাজে কমিয়ে এনেছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। সুদৃঢ় হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী।
গ্রামের জলাশয়ের কোলঘেঁষা দোকানে চা-পানের ফাঁকে কথা হয় মাছের পাইকারি ক্রেতা সেলিম মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, এখানকার বিভিন্ন পস্নাবনভূমি থেকে বিভিন্ন সময় মাছ ধরা হয়। তিনি সেখান থেকে মাছ কিনে বিভিন্ন বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন।
তার মতো প্রচুর পাইকারি ও খুচরা ক্রেতার ভিড় দেখা যায় পস্নাবনভূমির প্রকল্প এলাকায়। সকাল থেকেই পাইকাররা মাছভর্তি গাড়ি নিয়ে পাড়ি দেয় দূরের কোনো ক্রেতার জন্য।
গ্রামের বাসিন্দা মাদ্রাসা শিক্ষক কামাল হোসেন ফকির বলেন, এখানকার মানুষের আমিষের ঘাটতিজনিত রোগবালাই হয় না বললেই চলে।
কুমিলস্না ভিক্টোরিয়া কলেজে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছাত্র মৎস্য প্রকল্পে কর্মরত শামিম বলেন, ‘আমাদের এখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত কেউ বেকার নেই। সবাই মাছ চাষের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখার সুযোগ পেয়েছে। যেমন উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত।’
তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দাউদকান্দিকে মাছের ভান্ডারই মনে করেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ছয় মাস চাষে ধান মৌসুম শুরুর আগে জমিতে আলাদা পরিচর্যা করার প্রয়োজন হয় না। জমি থাকে পরিছন্ন। ধান ফলাতে প্রয়োজন হয় না বাড়তি সারের। তিনি আশা প্রকাশ করেন পস্নাবনভূমির মাছ চাষ দাউদকান্দি মডেল- এক সময় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
ইতিমধ্যেই দেশের অনেক জায়গায় পস্নাবনভূমিতে মাছ চাষ দাউদকান্দি মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে। অনেকেরই প্রত্যাশা পস্নাবনভূমিতে বর্ষায় পানি ঢুকে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় যে জমি জলের নিচে থাকে সেখানে যদি সারা দেশে দাউদকান্দির পস্নাবিত জমির মতো মাছ চাষ করা যায় তাহলে মৎস্য সম্পদ হবে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত।।
সূত্র:যায়যায়দিনবিড.কম।