বর্তমানে ডিম উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস বেশি জনপ্রিয়। ইংল্যান্ডের এই সংকর জাতের হাঁসের রং খাকি বলে নাম খাকি ক্যাম্পবেল। ক্যাম্পবেল নামক এক মহিলা ১৯০১ সালে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জাতের হাঁসের মধ্যে সংকরায়ন ঘটিয়ে এ জাত সৃষ্টি করেন। তাই এই জাতটির উৎপত্তিস্থল ইংল্যান্ড।
খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের বৈশিষ্ট্যসমুহঃ
- . পালকের রং খাকি, মাথা এবং ঘাড় ব্রোঞ্জ রঙের, পা ও পায়ের পাতার রং হাঁসার হলুদ, হাঁসীর কালো। ঠোটের রং হাঁসা নীলাভ, হাঁসী কালো।
- ডিম-এর উদ্দেশ্যে এ জাতের হাঁস পালন করা হলেও ডিম পাড়ার পর স্ত্রী হাঁস এবং হাঁসাকে মাংস হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
- এ হাঁসের মাংসও মুরগির মতোই পুষ্টিকর।
- এই হাঁস কেবল খাবার ও গলা ডোবানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি পেলেই সহজ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে। তাই পুকুর বা অন্যান্য জলাশয় ছাড়াই এ হাঁস পালন সম্ভব।
- খাকি ক্যাম্পবেল জাতের হাঁস বেশ কষ্টসহিষ্ণু।
- খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস সাড়ে ৪ মাস বয়স থেকেই ডিম দিতে শুরু করে এবং বছরে গড়ে প্রায় ২৫০- ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দেয়। এ জাত টানা ১-৩ বছর পর্যন্ত একই হারে ডিম পাড়ে।
- ডিমের রং সাদা এবং আকারও অপেক্ষাকৃত বড়।
- খাকি ক্যাম্পবেল জাতের হাঁসের বয়ঃ প্রাপ্তদের ওজন ২- ২.৫ কেজি হয়ে থাকে।
- ডিম উৎপাদনের জন্য দেশি হাঁসের ক্ষেত্রে পুরুষ হাঁসের প্রয়োজন হলেও খাকি ক্যাম্পবেল জাতের ক্ষেত্রে পুরুষ হাঁসের উপস্থিতি প্রয়োজন হয় না।
খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস বনাম লেয়ার মুরগি
১. লেয়ার মুরগি বছরে প্রায় ২০০-২৫০ টি ডিম দেয়।খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস বছরে প্রায় ২৫০- ৩০০ টি ডিম দেয়।
২. মুরগি থেকে মাত্র ১ থেকে দেড় বছর ভালো ডিম পাওয়া যায়। খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস টানা ২-৩ বছর একই হারে ডিম দেয়।
৩. মুরগির ডিমের গড় ওজন ৬০ গ্রাম। হাঁসের ডিমের গড় ওজন ৭০ গ্রাম।
৪. একদিনের মুরগির বাচ্ছার দাম ৬০-৬৫ টাকা। একদিনের হাঁসের বাচ্চার দাম খুব কম ২০ টাকা।
৫. মুরগি সারাদিন ধরেই যেকোন সময ডিম দেয়। হাঁস সকাল ৯টার মধ্যে ডিম পাড়া শেষ করে বলে ব্যবস্থাপনা সহজ।
৬. মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও গরম সহ্য করার ক্ষমতা অনেক কম। খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস রোগ প্রতিরোধ ও গরম সহ্য করার ক্ষমতা বেশি।
৭. অত্যধিক গরমে মুরগির ঘর ঠাণ্ডা রাখার দরকার হয় । হাঁসের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন হয় না।
০৯. ঘর, খাদ্য ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনেক বেশি। হাঁসের ক্ষেত্রে ঘর, খাদ্য ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ব্যয় কম। আর জলাশয়ে হাঁস পালন করলেতো খরচ ও ঝামেলা অনেক কম।
খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের বাসস্থানঃ
মুরগির মতো ততো ভালো বাসস্থান না হলেও চলে। পুকুর, ডোবা বা জলাশয়ে হাঁস পালন করলে শুধু রাতের ঘরের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে হাঁস প্রতি ৭৫ বর্গ সেন্টিমিটার (প্রায় ২.৫ বর্গফুট) জায়গা হলেই চলবে। সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় মেঝেতে হাঁস-পালন করলে প্রতি হাঁসের জন্য ১২০ বৰ্গ সেন্টিমিটার (প্রায় ৪ বৰ্গফুট) জায়গার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া হাঁসের চরবার জন্য ঘরে সঙ্গে কিছু ঘেরা জায়গা রাখলে ভালো হয়। হাঁসের ঘরের উচ্চতা ১৫০ সেন্টিমিটার (৫ ফুট) করলেই চলবে। মেঝে স্যাতসেঁতে হলে ঠান্ডা লেগে হাঁসের অসুখ হতে পারে। ঘরের মেঝে পাকা হওয়া ভালো, তবে মাটিরও করা যায়। মেঝে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন রাখতে হবে। ঘরে যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে তা লক্ষ রাখতে। ৩০০ বর্গফুট স্থানের জন্য ১টি ৬০ ওয়াটের বাল্ব দরকার।
খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের খাদ্যঃ
যদি পুকুর, ডোবা বা জলাশয়ে হাঁস পালন করা যায় তবে হাঁস নিজেদের খাবারের অনেকটাই নিজেরাই সংগ্রহ করে নিতে পারে। সাধারণত এরা বাগান ও জলাশয় থেকে ঘাস,লতা-পাতা, পোকা-মাকড়, কেঁচো, শামুক, গুগলি এবং উদ্ভিদ ও প্রাণিকণা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। শামুক ও গুগলি হাঁসের প্রিয় খাদ্য, যা আমিষ জাতীয় খাদ্যের চাহিদা অনেকটাই পুরণ করে থাকে। এগুলো অল্প খরচে সংগ্রহ করে সামান্য থেঁতলে পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে হাঁসকে অনায়াসেই সরবরাহ করা যায়। আবদ্ধ অবস্থায় খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস পালন করতে হলে সুষম খাদ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এখন সব ধরনের সুষম খাবার বা ফিড বাজারে কিনতে পাওযা যায়। আবার আপনি চাইলে নিজেও খাবার তৈরি করে নিতে পারেন।
হাঁসের খাদ্যের পরিমাণ ও হাঁসকে খাদ্য প্রদানের নিয়মঃ
পুকুর বা জলাশয়ে হাঁস পালন করলে খুব কম খাবারের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে হাঁসকে অর্ধক খাবার দিলেই চলে। তবে সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় হাঁস পালন করলে হাঁসপ্রতি বেশি পরিমাণে খাবারের প্রয়োজন হয়। ৮ সপ্তাহ বয়স অবধি একটি হাঁসের জন্য ৪-৫ কেজি এবং ২০ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত প্রতিটি হাঁসের জন্য ১২-১৩ কেজি সুষম খাদ্যের প্রয়োজন হয়। পূর্ণ বয়সে অর্থাৎ ডিম পাড়া অবস্থায় প্রতিটি হাঁসের জন্য গড়ে বছরে ৫০ কেজি সুষম খাবার লাগে। ২০ সপ্তাহের পরে ডিম পাড়ার হারের ওপর নির্ভর করে প্রতিটি হাঁসের জন্য দৈনিক ১২৫-১৫০ গ্রাম খাবারের প্রয়োজন হয়।
হাঁসকে নির্দিষ্ট পাত্রে খাবার দিতে হবে। পানি মিশিয়ে খাদ্য বা ম্যাশ নরম করে দিলে হাঁস তা সহজে খেতে পারে । খাবার মুখে নিয়েই হাস পানিতে মুখ দেয় বলেই খাবার পাত্রের কাছে সব সময় পানির পাত্র রাখতে হবে।
খাঁকি ক্যাম্পবেল হাঁসকে দৈনিক খাবার দেওয়ার হার
০-৪ সপ্তাহ – দৈনিক ৪ বার।
৪-৮ সপ্তাহ – দৈনিক ৩ বার।
৮ সপ্তাহের উপর – দৈনিক ২ বার।
হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনঃ
খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস ডিমে সাধারণত তা দিতে চায় না। ফলে কুরচি মুরগির সাহায্যে ডিম ফোটানো হয়। একটি কুরচি মুরগি ৮-১০টি হাঁসের ডিমে একবারে তা দিতে পারে। তবে ব্যবসার জন্য বেশি পরিমাণে বাচ্চা উৎপাদন করতে হলে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফোটানোর যন্ত্র বা ইনকিউবেটরের সাহায্যে মুরগির ডিমের মতোই হাঁসের ডিমও ফোটানো সম্ভব।
হাঁসের বাচ্চার যত্ন ও পরিচর্যা
খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের বাচ্চার ১ দিন থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি যত্নের প্রয়োজন। এ সময়ে উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যার অভাব হলে বাচ্চার মৃত্যুর হার অনেক বেশি হয়। প্রথম তিন সপ্তাহকাল হাঁসের বাচ্চাকে তারের জালের মেঝেতে অথবা মাটি বা সিমেন্টের মেঝেতে কাঠের গুড়ো বিছিয়ে তার উপর রাখা ভালো। কাঠের গুড়োর উপর বাচ্চা রাখলে মেঝেকে সব সময় শুকনো রাখতে হবে; সেজন্য গুড়া গুলোকে প্রতিদিনই একবার করে উল্টে দিতে হবে। তিন বা চার সপ্তাহ পর বাচ্চার অবস্থা অনুযায়ী তাদের সাধারণ মেঝেতে বা পুকুরে ছাড়া যেতে পারে।
২১ দিন থেকে ১ মাস পর্যন্ত হাঁসের বাচ্চাদের তাপ দিয়ে রাখতে হয়, যাকে ব্ৰডিং বলা হয়। প্রথম সপ্তাহে ঘরের তাপমাত্রা ৩০° সেন্টিগ্রেড হওয়া দরকার। এরপর প্রতি সপ্তাহে ৩° সে. করে কমিয়ে ২৪° সে. পর্যন্ত নামিয়ে আনতে হয়। গরমকালে এমনিতেই তাপমাত্রা বেশি থাকে বলে বাচ্চাদের অসুবিধা হয় না। তবে শীতকালে প্রয়োজনীয় তাপ না দিলে বাচ্চার মৃত্যুও হতে পারে। সদ্যজাত বাচ্চাকে প্রথম ২৪ ঘণ্টা কিছু খেতে দেবার প্রয়োজন হয় না। এরপর ২৩ দিন খাদ্যকে পানির সাথে মিশিয়ে নরম ও পাতলা করে খাওয়াতে হয়। এরপর সাধারণ খাবার অল্প পানিতে মিশিয়ে খেতে দিতে হয়।
বাড়ন্ত ও ডিম পাড়া হাঁসের যত্ন
বাচ্চার বয়স ১ মাস হয়ে গেলে ঘরে তাপ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। পানির পাত্রে পানির গভীরতা বাড়িয়ে ১২.৫-১৫.০ সেন্টিমিটার করতে হবে যাতে হাঁস মাথা ডোবাতে পারে। তাছাড়া খাবার ও পানির পাত্র দিতে হবে এবং থাকার জায়গার যাতে অভাব না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এ সময় কোনো কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন হয় না, দিনের আলোই যথেষ্ট।
অপরদিকে, খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যা পেলে সাড়ে ৪ মাস বয়স থেকেই ডিম দিতে শুরু করে। হাঁস প্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ছাড়াও চরবার জন্য কিছুটা জায়গা থাকা ভালো। ঘর সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে প্রয়োজনীয় খাবার পানি ও পানির ঘাটতি যেন না হয়। হাঁসের ঘরে দিনের আলো ছাড়াও আরো ২-৪ ঘণ্টা কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন । কেননা ডিম পাড়ার সঙ্গে আলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।
হাঁসের রোগ ও প্রতিষেধক ব্যবস্থা
খাকি ক্যাম্পবেল জাতের হাঁসের রোগ-ব্যাধি খুব একটা হয় না। রোগ-ব্যাধি নির্ভর করে খামারকারীর পরিচর্যার ওপর। যদি খামারী স্বাস্থ্যসম্মতভাবে হাঁস পালন করে তাহলে রোগ-ব্যাধির পরিমাণ একেবারেই থাকবে না। তবে খামারকারীকে হাঁসের মারাত্নক দুটি রোগ ডাক-প্লেগ ও ডাক-কলেরার অবশ্যই টিকা দিতে হবে। দুটি টিকা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য খামারকারীকে যেতে হবে নিকটস্থ পশু চিকিৎসা কেন্দ্রে।
৩ সপ্তাহ বয়সে বুকের মাংসে ১ সষ ডাক প্লেগ টিকা দিতে হয়। ১৫ দিন পর পুনরায় বুকের মাংসে ডাক প্লেগ টিকা দিতে হবে। ৭০ দিন বয়সে কলেরার টিকা ১/স । ১৩০ দিন বয়সে আবার কলেরার টিকা দিতে হবে।
সূত্র -কৃষি জীবন