মাছ চাষে কম সময়ে অধিক উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে হরদম বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয় রয়েছে। তবে এতে খরচ বাড়ে। চীনের তরুণ উদ্যোক্তা টাইগার ব্যয় সাশ্রয়ে ব্যবহার করছেন বিশেষ ধরনের মোটর
চীনের সাংহাইয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল চীনের মাছ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা নিতে।
সেখানে টাইগার নামের এক তরুণ উদ্যোক্তার সঙ্গে দেখা। তিনি চীনের সুজু শহরের উপকণ্ঠে আইপিআরএস প্রযুক্তি ব্যবহারে মাছ উৎপাদন করেন। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে অ্যারেটর বা ব্লোয়ার সচল রাখতে হয় বলে আইপিআরএসের বড় একটি খরচ বিদ্যুৎ খাতে। উদ্যোক্তা টাইগার তার আইপিআরএসে ব্যবহার করছেন বিশেষ ধরনের মোটর।
টাইগার আমাকে বিশেষ এই মোটর সম্পর্কে ধারণা দিতে নিয়ে গেলেন চীনের প্রকৌশলী স্টিভেনের কাছে। স্টিভেন বললেন, ‘কম সময়ে অধিক উৎপাদন করতে চাইলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতেই হবে। আইপিআরএস হচ্ছে মাছ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি। আমরা চীনসহ সারা বিশ্বে এক হাজারের ওপর আইপিআরএস প্রযুক্তির খামার স্থাপন করে দিয়েছি।
বেশ ভালো মাছ উৎপাদন হচ্ছে সেগুলোতে।’
কিন্তু খামারিদের একটিই প্রশ্ন, বিদ্যুৎ খরচ কিভাবে কমানো যায়? এ সমস্যা সমাধানে দুই বছর কাজ করার পর আমরা সফল হয়েছি। আইপিআরএসে মাছ চাষের দুটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, বিদ্যুতের সাহায্যে সব সময় কৃত্রিম প্রবাহ চালু রাখা। দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের দাম বছর বছর বেড়ে যাচ্ছে।
আমরা এই দুই চ্যালেঞ্জকে একটি যন্ত্রের মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছি।
অবিরত বিদ্যুৎ প্রবাহ চালু রাখা কী করে সম্ভব? যেকোনো কারণেই জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ বন্ধ থাকতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নির্দিষ্ট সময় পর অ্যারেটার না চললে, অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ থাকলে মাছ সব মরে যাবে! এ জন্য আমরা এক ধরনের ডিসি মোটর তৈরি করেছি, যাতে বিদ্যুতের খরচ কমে আসবে। এটি একই সঙ্গে বিদ্যুৎ, ব্যাটারি কিংবা সৌরবিদ্যুতে চালানো যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন ব্লোয়ারটি আগের ব্লোয়ারের মতো কাজ করবে, কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ হবে আগের চেয়ে অর্ধেক। আবার এর ভেতরে একটি চিপ বসানো আছে। যেটি মোবাইল ফোনেই চালু বা বন্ধ করা যায়। স্মার্ট টেকনোলজি।
বাংলাদেশে প্রথম আইপিআরএস স্থাপন করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আকবর হোসেন। তিনি তুলে ধরেছিলেন আইপিআরএসে মাছ চাষের সম্ভাবনার কথা। পাশাপাশি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও তিনি তুলে ধরেন। বলেছিলেন, বিদ্যুৎ খরচটা অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। এই সময়ে দেশের অনেক উদ্যোক্তা যুক্ত হচ্ছেন আইপিআরএসের মাছ চাষে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে উৎপাদক ও ভোক্তা দুজনই লাভবান হবেন।
টাইগারের কাছে জানতে চাই, আইপিআরএসের সম্ভাবনা কতটুকু? টাইগার বলেন, ‘যদি সত্যিকার অর্থেই খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য—দুটিকে একসঙ্গে ভাবতে চান, তবে প্রযুক্তির ব্যবহার না করে সেটা দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার হবে। শুধু প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়, বিশাল জনসংখ্যাকে না খাইয়ে রাখার মতো চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনে আসতে হবে। আমরা দেখেছি বেশি পরিমাণে মাছ চাষ করতে গিয়ে ফসলি জমিতে পুকুর হয়েছে, বছরের পর বছর পরিবেশের কতটা ক্ষতি হয়েছে। এর একটি বিজ্ঞানসম্মত সমাধান আইপিআরএস। আইপিআরএসের বড় একটি প্রতিবন্ধকতা ছিল বিদ্যুতের খরচ। সেটিকে কমিয়ে আনার জন্য আমি এখানে ডিসি মোটর ব্যবহার করছি। বিদ্যুৎ খরচ একেবারে অর্ধেকে নেমে এসেছে।’
চীনে দিনের বেলায় বিদ্যুতের দাম বেশি। রাতে কম। তাই টাইগাররা রাতের বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে সঞ্চয় করে দিনে চালাচ্ছেন। টাইগারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তাঁরা আইপিআরএসে মাছ চাষের একটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। সেটির কাজ চলছে। গত দুই বছরে পুরো চীনের প্রায় এক হাজারের মতো আইপিআরএস স্থাপিত হয়েছে। শুধু আইপিআরএসেই নয়, অক্সিজেন সরবরাহ বা অ্যারেটর কিন্তু সাধারণ পুকুরে মাছ চাষের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। বিদ্যুৎ খরচ কমাতে তাঁরাও এ মোটর ব্যবহার করতে পারেন। এর মাধ্যমে শুধু যে বিদ্যুৎ খরচ কম হচ্ছে তা নয়, একই সঙ্গে রিচার্জেবল ব্যাটারি বা আইপিএস, সৌরবিদ্যুৎ এমনকি উইন্ডমিলের বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়।
যন্ত্রটি এমনভাবে প্রগ্রাম করা যে, পাওয়ার গ্রিড না পেলে সেটি ব্যাটারির বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে। সৌরবিদ্যুৎ বা উইন্ডমিল থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিতে পারে। টাইগার জানালেন, সৌরবিদ্যুৎ ও উইন্ডমিল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ খরচ ৯০ শতাংশ কমিয়ে এনেছেন।
আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরুতে বেশ ব্যয়বহুল। সবার জন্য এই প্রযুক্তি নয়। তবে অল্প জায়গায় গুণগতমানের অধিক মাছ চাষের জন্য এটি একটি আদর্শ পদ্ধতি। এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। আবার অনেক ঝুঁকিতে থাকা মাছের প্রজাতিও রক্ষা করা যাবে।
সূত্র. কালের কন্ঠ