ডা. মো. নূরে আলম
জুন ২০, ২০২০
কৃষি খাত করোনাসহ সকল দুর্যোগ কিংবা মহামারীতে বাংলাদেশের মূল শক্তি ও আশার জায়গা যা কৃষি, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য এই তিনটি খাতকে নিয়ে গঠিত। এ সফলতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে, কেননা তিনিই কৃষিবিদদের ক্লাস ওয়ানের সম্মান এবং কৃষি শিক্ষা ও গবেষণাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। তারই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দুধ-ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার পথে, ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম, মাছ উৎপাদনে বিশ্বে রোল মডেল। কোন একটি সেক্টরের গুরুত্ব বুঝতে হলে জিডিপিতে তার অবদান কত এটিই মূল নির্ণায়ক। সঠিক ও বাস্তব সম্মত তথ্য যেমন একটি সেক্টরের গুরুত্ব বুঝাতে সহায়তা করে তেমনি পলিসি মেকারদের গুরুত্বপূর্ণ খাত সনাক্তকরণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহায়তা করে।
জিডিপির ২০১৮-১৯ এর তথ্যানুসারে (টেবল জিডিপিতে কৃষি, প্রাণি ও মৎস্য খাতের অবদানের তুলনামূলক চিত্র)-
জিডিপি
২০১৮-১৯ |
চলতি মূল্যে | স্থায়ী মূল্যে |
কৃষি জিডিপিতে অবদান |
||
মূল্য (মিলিয়ন টাকা) | হার (%) | মূল্য (মিলিয়ন টাকা) | হার (%) | ||
কৃষি | ৩,২২৩,৯৩৮ | ১৩.৩২% | ১,৪৫১,৩৭০ | ১৩.৬৫% | |
শষ্য | ১,৭২৩,২৯৮ | ৭.১২% | ৭৫১.১৮৫ | ৭.০৬% | ৫৫% |
প্রাণিসম্পদ | ৪৩২,১৫১ | ১.৭৯% | ১৫৫,৯৭৮ | ১.৪৭% | ১৪% |
মৎস্য | ৭৪২,৭৪৭ | ৩.০৭% | ৩৭১,৪৬২ | ৩.৪৯% | ২২% |
উপরোক্ত ডাটা হতে কৃষি. প্রাণি ও মৎস্য খাতের ডাটাগুলোতে কৃষি মৎস্য খাতের অবদান যথাযথ ফুটে উঠলেও প্রাণিসম্পদ খাতের তথ্য সঠিকভাবে ফুটে ওঠেনি। প্রাণিসম্পদের অবদানকে তুলে ধরতে মৎস্যের তথ্যকে ধ্রুবক হিসেবে নিয়ে তুলনা করলে চিত্রটি হবে অবাস্তব । মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২০১৮-১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্য অনুসারে প্রাণিসম্পদ খাত হতে দেশের মোট প্রাণিজ প্রোটিন সরবরাহের প্রায় ৮০% আসে।
উক্ত প্রতিবেদন অনুসারে-
- মৎস্য উৎপাদন- ৪৩.৮১ লাখ টন
- মাংস উৎপাদন- ৭৫.১৪ লাখ টন
- দুধ উৎপাদন- ৯৯.২৩ লাখ টন
- ডিম উৎপাদন- ১৭১১ কোটি।
মৎস্য অবদানের সাথে তুলনা করলে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের অবদানকে বাস্তবসম্মত মনে হওয়ার কোন সুযোগ নেই। কেবল মাংস উৎপাদন বিবেচনা করলেও মাছের চেয়ে প্রাণিসম্পদের অবদান ১.৭ গুণ বেশি, দুধ, ডিম বাদ! কিন্তু মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের অবদান অবদান মাত্র ১.৭৯%, মৎস্যের ৩.০৭%!!!
অথচ ডেইরি ইনডাস্ট্রি একটি উদীয়মান ও প্রতিষ্টিত শিল্প, পোল্ট্রি খাত দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প খাত। যাদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে গ্রামীন অর্থনীতি। শুধু তাই নয় দেশি, বিদেশি সহস্রাধিক কোম্পানি ব্যবসা করছে এ খাতে। কেবল ব্রয়লার হতে তৈরি হয় ৫০০র বেশি ধরনের খাবার, দুধ থেকে শতাধিক পণ্য! হাজারো ফিড মিল, মেডিসিন উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, হ্যাচারি, ব্রিডার, প্যারেন্ট, বানিজ্যিক খামার, বিক্রয়, পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে উঠার পাশাপাশি চিকেন ও মিট প্রসেসিং প্লান্ট সমূহ গড়ে উঠছে। বেকারি পণ্যে দুধ, ডিমের ব্যবহার সর্বজন বিাধত। সাথে আছে ব্যাকইর্ড পোল্ট্রি ও অন্যান্য গবাদিপশু যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে জীবন্ত ব্যাংক হিসেবে কাজ করছে, শুধু পুষ্টির চাহিদা পূরণ নয় বরং নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। হাওড়, নদীতে কোটি হাঁসের আনাগুনা যেন দৃষ্টির বাইরেই থেকে যাচ্ছে! পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে মানুষ দিন দিন প্রাণিজ আমিষের দিকে ঝুঁকছে। পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি মোট শ্রম শক্তির ২০% প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০% প্রাণিসম্পদ খাতের সাথে জড়িত। শিক্ষিত বেকার জনগোষ্টির কর্মসংস্থানের বৃহত্তম খাত হতে পারে প্রাণিসম্পদ খাত।
দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য প্রাণিসম্পদের গুরুত্বপূর্ণ উপপণ্য বা উপজাত পণ্য। শিল্পোৎপাদন ও জিডিপিতে অবদান যথাক্রমে ২% ও ০.৬%। ২০১৭-১৮ বছরে রপ্তানিতে তৈরি পোষাকের পরই চামড়া শিল্পের অবদান। ২০১৭ সালকে বাংলাদেশ সরকার চামড়া, চামড়াজাত পন্য এবং চামড়াজাত পাদুকাকে “Products of the Year” ঘোষণা করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চামড়া খাতের রপ্তানি রূপরেখা অনুসারে ২০২৫ সালের মধ্যে চামড়া রপ্তানিতে বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের ভিতর নিয়ে আসা, ২০২১ সালের মধ্যে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। (চামড়া খাতের রপ্তানি রূপরেখা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ২/১৯)। অথচ অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় একটি খাতকে প্রাণিসম্পদের অবদান হিসেবে গণ্য না করা হতাশাজনক। সাধারণভাবে বুঝা যায় গবাদিপশুর সমস্ত শরীরের তুলনায় চামড়ার পরিমাণ কত নগন্য! যদি জিডিপিতে চামড়া শিল্পের অবদান ০.৬% হয় তবে সম্পূর্ণ প্রাণিটির অবদান কি করে চামড়ার চেয়ে কম হয়। হয়তোবা প্রসেসড চামড়াজাত পণ্যকে বুঝাতে গিয়ে ভ্যালু এডিশনের কথা বলা হবে কিন্তু দুধ, ডিম, মাংস মিলে কি হবে জিডিপিতে মোট অবদান? অতএব জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের সত্যিকার অবদান হবে বর্তমান তথ্য হতে অনেক বেশি।
সত্যকে প্রতিষ্ঠা না করতে পারার ব্যর্থতা কার সেটি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিশেষ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের সঠিক মূল্যায়ন যেমন উন্নয়ন নিশ্চিত করবে তেমনি রাষ্ট্রের পলিসি মেকারদের সঠিক বার্তা দিতে সহায়তা করবে। আশার কথা হলো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় ও সচিব মহোদয়ের গতিশীল নেতৃত্ব সকল তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করবে যা প্রাণিসম্পদকে এগিয়ে নিবে বহুদূর।
লেখক: ডা. মো. নূরে-আলম, ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর