মিশ্র মাছ চাষ করে বর্তমানের অনেকে লাভের মুখ দেখছে। মাছ চাষের উপযোগী এবং বাজারজাত করতে পরিচর্যার পাশাপশি পুকুরে সঠিক মাছে সময় উপযোগী মাছকে খাওয়ার দিতে হবে। মিশ্য মাছ চাষের উপযোগী খাদ্যের তালিকা নিম্নে দেওয়া হলো…
খাদ্য প্রধানত দু’প্রকার হয়ে থাক। ক. প্রাকৃতিক খাদ্য খ. সম্পূরক খাদ্য।
১. উদ্ভিদ কণা (Phytoplancton): জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সবুজ কণা তৈরি হয়, যা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন- শেওলা, ফেকাস, নষ্টক, ডায়াটম, ভলবক্স, এনাবিনা ইত্যাদি।
২. প্রাণী কণা (Zooplanton): জলাশয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। যেমন ময়না, ড্যাফনিয়া, বসমিনা, কেরাটেলা, ফিলিনিয়া, সাইক্লপস, প্রোটোজোয়া, রটিফার ইত্যাদি।
এসব প্রাকৃতিক খাদ্য জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। তবে বেশি পরিমাণে জন্মানোর জন্য জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। প্রাকৃতিক খাদ্য খাওয়া মাছ দ্রুত বড় হয় ও মাছ খেতে সুস্বাদু। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য আছে কি-না বোঝার পদ্ধতি হচ্ছে কাচের গ্লাসে পুকুরের স্বচ্ছ পানি নিয়ে সূর্যের আলোর দিকে ধরলে যদি গ্লাসে ৮-১০টি কণা দেখা যায় তবে বুঝতে হবে প্রাকৃতিক খাদ্য আছে। সেক্কিডিস্ক বা হাত পুকুরের পানিতে ডুবালে যদি হাতের তালু বা ডিস্ক দেখা যায় তবে বুঝতে হবে প্রাকৃতিক খাদ্য নাই। পুকুরের পানির রঙ হালকা সবুজ বা বাদামি দেখা গেলে বুঝতে হবে প্রাকৃতিক খাদ্য আছে। প্রাকৃতিক খাদ্য যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও মজুদ মাছের মোট ওজনের ২-৫% সম্পূরক খাদ্য দিতে হয়।
৩. সম্পূরক খাদ্য: পুকুরে উৎপাদিত প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব হলে মাছের দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধির নিমিত্তে প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার সরবরাহ করা একান্ত প্রয়োজন। মাছ ছাড়ার পরের দিন হতে প্রতিদিন সকালে ও বিকেল মজুদকৃত মাছের মোট শরীরের ওজনের শতকরা ৫-৬ ভাগ হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য, প্রতি ২০ কেজি মাছের জন্য অন্ততপক্ষে ১ কেজি খাবার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি ১৫ দিন বা ১ মাস অন্তর একবার জাল টেনে কিছু মাছ ধরে ওজনের গড় বের করে নিয়ে মোট ওজনের উপর আনুপাতিক হারে খাবার দিতে হবে।
সরিষার খৈল ৩০% ও গমের ভুসি বা চালের কুঁড়া ৭০% অনুপাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে দুটি খাবারের মিশ্রণ পুকুরের বিভিন্ন স্থানে অথবা ৩-৪টি নির্দিষ্ট স্থানে প্রয়োগ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, ভাসানো খাবার হিসাবে গমের ভুসি বা কুঁড়া পানির উপরে শুকনা অবস্থায় সপ্তাহে অন্তত ২-৩ দিন সরবরাহ করা ভালো। সহজ ব্যবস্থাপনায় অল্প খরচে শুধুমাত্র গমের ভুসি বা চালের কুঁড়া শতাংশ প্রতি ১ম মাসে ৫০ গ্রাম, ২য় মাসে ১০০ গ্রাম, ৩য় মাসে ১৮০ গ্রাম, ৪র্থ মাসে ২২০ গ্রাম, ৫ম মাসে ২৬০ গ্রাম ও ৬ষ্ঠ মাসে ৩০০ গ্রাম দিতে হবে।
৪. সম্পূরক খাদ্য তৈরির নিয়ম : ফিশমিল ১০%, চালের কুঁড়া ৫৩%, সরিষার খৈল ৩০.৫০%, ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ ০.৫% ও চিটাগুড় ৬% মেপে নিতে হয়। এগুলো গুঁড়ো করে মিশাতে হবে। এরপর পানি দিয়ে ম- তৈরি করে পিলেট মেশিনে দিয়ে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করতে হবে। এগুলো শুকিয়ে মাছকে খেতে দেয়া যাবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে সম্পূরক খাদ্য দিতে হয়। খাদ্যগুলো পুকুরে পানির নিচে নির্দিষ্ট গভীরতায় দিতে হয়। ভাসমান খাদ্য দিলে খাদ্যের অপচয় কম হয়। সম্পূরক খাদ্য দিলে মাছের খাদ্যের অভাব দূর হয়। মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও টোপাপানা, ক্ষুদিপানা, কলাপাতা, নেপিয়ার বা প্যারা জাতীয় নরম ঘাস, পাতা ইত্যাদি প্রতিদিন লবণ-পানিতে ধুয়ে সকাল-বিকেল পুকুরে আয়তাকার বেষ্টনীর মধ্যে সরবরাহ করা যেতে পারে।
৫. অন্যান্য পরিচর্যা: পুকুরের পানি ও মাটির বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে পুকুরে সার ও খাবার প্রয়োগ করা সমীচীন হবে। মাছের শারীরিক বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও রোগবালাই পরীক্ষা করার জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার জাল টেনে নমুনা দেখা তথা সামগ্রিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, কার্বন ডাইঅক্সাইড ও প্লাঙ্কটনের পরিমাণ নিয়মিতভাবে পরিমাপ করা প্রয়োজন। মাছ ধরে পুনরায় পুকুরে ছাড়ার আগে ২০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম পটাশ (পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট) অথবা ২০ লিটার পানিতে ১ মুঠো লবণ-পানি দ্রবণে ১-২ মিনিট গোসল করানো উচিত। কোনো রোগবালাই দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। পুকুরের পানির ওপর ঘন লাল স্তর পড়লে তা কলাগাছের পাতা পেঁচিয়ে পানির ওপর দিয়ে ভাসমান অবস্থায় টেনে নিয়ে এক জায়গায় জমা করে ঘন ফাঁসের জাল বা কাপড় দিয়ে তুলে ফেলতে হবে। সকালের দিকে বা দিনের অন্য সময়ে যদি অত্যধিক পরিমাণে মাছ পানির ওপর ভেসে উঠে খাবি খেতে দেখা যায় তাহলে ধরে নিতে হবে যে পানিতে অক্সিজেনের অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় পুকুরে জাল টেনে, বাঁশ পিটিয়ে বা সাঁতার কেটে পানিতে ঢেউ এর সৃষ্টি করে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কয়েক দিনব্যাপী মেঘলা আকাশ থাকলে মাছের এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। পুকুরে মাছ খাবি খাওয়া অবস্থায় সাময়িকভাবে সার ও খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। বাইরের বিষাক্ত পানি যেন পুকুরে কোনো অবস্থাতেই না ঢুকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পুকুরে তন্তুজাতীয় শেওলা ও অন্যান্য আগাছার পরিমাণ বেড়ে গেলে পুকুরের পানিতে অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলে মাছ মারা যেতে পারে। তাই তন্তুজাতীয় শেওলা ও জলজ আগাছা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৬. মাছ আহরণ ও ফলন: সময়মতো মাছ ধরা ও বিক্রয় করা মাছ চাষের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। অপেক্ষাকৃত বড় আকারের বিক্রয়যোগ্য মাছ ধরে বাজারজাত করা উচিত। আংশিক আহরণ পদ্ধতিতে মাছ ধরে নেয়ার পর আহরণকৃত মাছের সংখ্যা পূরণ করার জন্য বড় আকারের সমপরিমাণ পোনা পুকুরে ছাড়তে হবে। উপোরল্লিখিত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে এবং আংশিক পদ্ধতিতে মাছ আহরণ করা হলে অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব।
তথ্য সুত্র: এআইএস