বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচিতি
রাজধানী ঢাকা থেকে ১২০ কিলোমিটার উত্তরে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। প্রশাসনিকভাবে এটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। পরিবেশ এবং মৎস্য সম্পদের প্রকৃতি অনুযায়ী দেশের ৫টি এলাকায় ইনস্টিটিউটের ৫টি গবেষণা কেন্দ্র ও ৫টি উপকেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো-ময়মনসিংহে অবস্থিত স্বাদুপানি কেন্দ্র, চাঁদপুরে অবস্থিত নদী কেন্দ্র, খুলনার পাইকগাছায় অবস্থিত লোনাপানি কেন্দ্র, কক্সবাজারে অবস্থিত সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র এবং বাগেরহাটে অবস্থিত চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র এবং উপকেন্দ্র ৫টি হলো- রাঙ্গামাটিতে কাপ্তাই লেক উপকেন্দ্র, সান্তাহারে প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র, যশোরে স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় অবস্থিত নদী উপকেন্দ্র এবং সৈয়দপুরে অবস্থিত স্বাদুপানি উপকেন্দ্র। ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম এসব কেন্দ্র ও উপকেন্দ্রের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে। মৎস্যসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য।
ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা ও সার্বিক কর্মকান্ডের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নরূপঃ
► দেশের মিঠাপানি ও সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সার্বিক উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা এবং সমন্বয় সাধন।
► গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প ব্যয় ও স্বল্প শ্রমনির্ভর পরিবেশ উপযোগী উন্নত মৎস্যচাষ ও ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবন।
► মৎস্য বাণিজ্যিকীকরণ সহায়ক বহুমূখী মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন বিষয়ক গবেষণা পরিচালনা।
► চিংড়িসহ অন্যান্য অর্থকরী জলজসম্পদের উন্নয়নে যথাযথ প্রযুক্তি উদ্ভাবন।
► গবেষণাভিত্তিক প্রযুক্তি হস্তান্তর, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গঠন।
► মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন নীতি প্রণয়নে সরকারকে পরামর্শ প্রদান।
গবেষণা কেন্দ্র ও উপকেন্দ্রসমূহ
স্বাদুপানি কেন্দ্র ও উপকেন্দ্রসমুহঃ প্রায় ৪০.৫ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট স্বাদুপানি কেন্দ্রটি ময়মনসিংহে ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয়ের সাথে অবস্থিত। পুকুরভিত্তিক মৎস্যচাষ উন্নয়ন, মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবন, মাছের পুষ্টি ও খাদ্য উন্নয়ন, রোগবালাই দমন, প্রণোদিত পদ্ধতিতে মিঠাপানির ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদন, জীনপুল সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে এ কেন্দ্রে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে। এ কেন্দ্রের অধীনে যশোর ও সৈয়দপুর উপকেন্দ্র হতে ফার্মিং সিস্টেম গবেষণাসহ অন্তঃপ্রজনন সমস্যা নিরসন ও হ্যাচারিজাত পোনার মানোন্নয়ন বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সান্তাহারস্থ প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র হতে প্লাবনভূমিতে মৎস্যচাষ উন্নয়ন ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
নদী কেন্দ্র ও উপকেন্দ্রসমুহঃ চাঁদপুর জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে ১৭.২ হেক্টর এলাকা নিয়ে ইনস্টিটিউটের নদী কেন্দ্র অবস্থিত। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন মৎস্য প্রজাতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে এ কেন্দ্রে গবেষণা পরিচালিত হয়ে থাকে। এ কেন্দ্র থেকে ইতোমধ্যে ইলিশসম্পদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন উৎস চিহ্নিতকরণ, পেনে মাছ চাষ ও পাঙ্গাস মাছের পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের অধীনে রাঙ্গামাটিস্থ উপকেন্দ্র থেকে কাপ্তাই লেকে মৎস্যচাষ ও ব্যবস্থাপনা এবং খেপুপাড়াস্থ উপকেন্দ্র ইতে ইলিশ মাছের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা করা হয়।
লোনাপানি কেন্দ্রঃ খুলনা জেলা শহর থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরে পাইকগাছা থানায় ২৮.৭৪ হেক্টর জায়গা নিয়ে ইনস্টিটিউটের লোনাপানি কেন্দ্র অবস্থিত। এ কেন্দ্র হতে কৃত্রিম উপায়ে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের উন্নততর কলাকৌশল উদ্ভাবন, চিংড়ি চাষীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বাগদা চিংড়ির প্রাকৃতিক উৎস নিরূপণ এবং উপকূলীয় পরিবেশসহ চিংড়ির পোনা সংগ্রহকালে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে।
সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রঃ প্রায় ৪ হেক্টর এলাকা নিয়ে এ কেন্দ্রটি কক্সবাজার জেলা সদরে অবস্থিত। এ কেন্দ্রে যে সকল বিষয়ে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে তা হলো- অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুদ নিরূপণ, চিংড়িসহ সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন, ফসলচক্র-ভিত্তিক মৎস্য ও চিংড়ি চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পণ্যের মনোন্নয়ন ও সংরক্ষণ কলাকৌশল ইত্যাদি।
চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রঃ আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং ব্যবহারের মাধ্যমে বাগেরহাটসহ খুলনা অঞ্চলের চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি, রোগ নির্ণয় ও প্রতিকার এবং চিংড়িজাত পণ্যের গুণগত মানোনয়নের লক্ষ্যে গবেষণার মাধ্যমে উপযুক্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য বাগেরহাটে একটি চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আট একর আয়তন বিশিষ্ট উক্ত কেন্দ্রে ১,৭৬৮ বর্গ মিটার আয়তন বিশিষ্ট ১টি ২তলা অফিস-কাম গবেষণাগার ভবন, ১টি হ্যাচারী, ১টি ট্রেনিং ডরমেটরী, ১টি স্টাফ ডরমেটরী, এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। অফিস ভবনে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমন্বিত ৪টি গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে। উক্ত ৪টি গবেষণাগার থেকে চিংড়ির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, চিংড়ির খাদ্য ও পুষ্টিমান, চিংড়ির গুণগত মান উন্নয়ন এবং মাটি ও পানির গুণাগুণ বিষয়ক গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে।
উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ
ইনস্টিটিউট জাতীয় চাহিদার নিরিখে নিবিড় গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লগ্ন (১৯৮৪ ইং) হতে মৎস্য প্রজনন, চাষ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ৫৭ টি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সাফল্য লাভ করেছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহের অধিকাংশই প্রশিক্ষণ ও প্রদশর্নী কার্যক্রমের মাধ্যমে সফলভাবে সারাদেশে চাষী ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাকালীন বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন ছিল মাত্র ৮.০ লক্ষ মে. টন। ইনস্টিটিউট কর্তৃক লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের ফলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন ৩৮.৭৮ লক্ষ মে. টনে উন্নীত হয়েছে।
প্রকাশনা
ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ, উদ্যোক্তা/ চাষী পর্যায়ে হস্তান্তর ও জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে এ পর্যন্ত মৎস্যচাষ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ৩টি বই, ২৬টি সম্প্রসারণ পুস্তিকা/ ম্যানুয়াল, ৩০টি লিফলেট, ২৩টি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল ও ২৫টি পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে। প্রযুক্তিভিত্তিক প্রকাশনা ছাড়াও ইনস্টিটিউট নিয়মিতভাবে কারিগরি প্রতিবেদন, বিভিন্ন সেমিনার/ কর্মশালার প্রসিডিংস প্রকাশ করে থাকে। ইনস্টিটিউট থেকে Bangladesh Journal of Fisheries Research শীর্ষক একটি বৈজ্ঞানিক জার্নাল এবং Fisheries Newsletter বছরে দুটি ইস্যুতে প্রকাশিত হয়ে থাকে।
সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর
প্রযুক্তিভিত্তিক মাছ চাষের মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণ, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, দারিদ্র বিমোচন এবং সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাথে দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এসব সংস্থাগুলো হলোঃ
১.বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ২. জনতা ব্যাংক, ৩. স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, ৪. ওয়ার্ল্ডফিস সেন্টার, ৫. নিরিবিলি গ্রুপ অব কোম্পানীজ, কক্সবাজার, ৬. ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট, ৭. ব্র্যাক, ৮। জিআইজেড।
সমঝোতা স্মারকের আওতায় ইনস্টিটিউট উল্লিখিত সংস্থাসমূহের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে আধুনিক ও লাগসই মৎস্যচাষ প্রযুক্তি হস্তান্তর, চাষীদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদেরকে প্রযুক্তিভিত্তিক মাছ/ চিংড়ি চাষের জন্য ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা প্রদান করে আসছে।
পুরস্কার
গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও মাছের জাত উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান ও সাফল্যেও জন্য ইনস্টিটিউটের ৩ জন বিজ্ঞানী ১৯৯৭, ২০০২, ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মৎস্য সপ্তাহ/পক্ষ স্বর্ণ পদক এবং ২০০২ ও ২০০৪ সালে ২ জন রৌপ্য ও ১ জন ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেছেন।
ভবিষ্যৎ গবেষণা পরিকল্পনা
ইনস্টিটিউট দেশের চাহিদা ও বাস্তবতার আলোকে গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং মৎস্যসম্পদের উন্নয়নে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ গবেষণা পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছেঃ
১. উন্নত জাত ও বিপন্ন প্রজাতির মাছের জিন পুল সংরক্ষণের লক্ষ্যে হিমায়িত পদ্ধতিতে সিমেন সংরক্ষণ
২. বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন লোনাপানি ও সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন
৩. চিংড়ির ভাইরাস রোগ সনাক্তকরণের জন্য PCR Based গবেষণা পরিচালনা
৪. সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ও মজুদ নির্ণয়ের গবেষণা
৫. সামুদ্রিক জলজ উদ্ভিদের (Sea Weed) চাষ
৬. স্বাদুপানি ও সামুদ্রিক মাছের জীব বৈচিত্র্য ও জেনেটিক রিসোর্স গবেষণা
৭. জলজ পরিবেশে দূষণের কারণ, মাত্রা ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে গবেষণা
৮. ফার্মিং সিষ্টেম মডেলিং
৯. কাঁকড়া, কুচিয়া, শামুক, ঝিনুকসহ অপ্রচলিত জলজ প্রাণীর প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন।
পরিকল্পনাধীন গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে আরও উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব হলে দেশে আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ৪৫ লক্ষ মে. টন মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যুগান্তকারী অগ্রগতি সাধিত হবে।
ওয়েবসাইটঃ www.fri.gov.bd