বিজ্ঞানীদের হাত ধরে দেশি মাছ ফিরছে পাতে
মাছে–ভাতে বাঙালি—বেশ পুরোনো প্রবাদ। দেশে ধানের উৎপাদন বাড়ায় কয়েক বছর ধরে ভাতের অভাব নেই। কিন্তু দেশি মাছ কম পাওয়া যাচ্ছিল। নদীতে দূষণ ও পলি পড়ায় মাছের উৎপাদন কমে আসে। দামও সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যায়। কিন্তু সেই অবস্থার বদল ঘটিয়েছেন দেশের মৎস্যচাষিরা।
পুকুরে ও উন্মুক্ত জলাশয়ে উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষ সেই বদল এনে দিয়েছে। ২৩টি দেশি মাছের চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করে মৎস্যচাষিদের হাতে তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা এসব দেশি মাছের জাত সংরক্ষণ করে কীভাবে সেগুলো বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করে উৎপাদন বাড়ানো যায়—সেই উপায় বের করেছেন।
গবেষণাকাজে সাফল্য আসায় গত ১০ বছরে দেশি ছোট মাছের উৎপাদন প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এসব মাছের জাত উন্নয়নে এবং আরও কয়েক প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এইচ এম কোহিনূর প্রথম আলোকে বলেন, বিলুপ্তপ্রায় জাতগুলো বাছাই করে গবেষণা করা হচ্ছে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সেই জাতগুলোর পোনা উৎপাদনে সাফল্য এসেছে এবং চাষাবাদের মাধ্যমেও সুফল পাওয়া গেছে। এই ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহে প্রধান কার্যালয় ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর ও যশোর উপকেন্দ্রে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে কাজ চলছে।
বিলুপ্তপ্রায় জাত পুনরুদ্ধার
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, বাংলাদেশে মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মধ্যে ১৪৩ প্রজাতি হচ্ছে ছোট মাছ।
মৎস্য ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পাবদা, গুলশা, গুজি আইড়, রাজপুঁটি, চিতল, মেনি, ট্যাংরা, ফলি, বালাচাটা, শিং, মহাশোল, গুতুম, মাগুর, বৈড়ালি, কুঁচিয়া, ভাগনা, খলিশা, কালবাউশ, কই, বাটা, গজার, সরপুঁটি ও গনিয়া—এই ২৩ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে এবং দামও ক্রেতাদের নাগালের মধ্যেই।
ইনস্টিটিউটটির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সেলিনা ইয়াসমিন জানান, উন্মুক্ত জলাশয় থেকে যে মাছগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে, সেই মাছগুলোর সংরক্ষণ করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করে পুকুরে কিংবা আবদ্ধ জলাশয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করাই মূল উদ্দেশ্য। বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা, শোল, বাইম, রানি, কাজলি, বাতাসি, কাকিলা, কাওন ও ভোল মাছের প্রজনন এবং চাষপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে।
সম্প্রতি ময়মনসিংহ শহরের মেছুয়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য মাছের সঙ্গে দেশি নানা রকমের মাছ বিক্রি হচ্ছে। মাছ কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী আবু সাঈদ বলেন, বেশ কয়েক বছর আগেও দেশি মাছগুলো বাজারে সচরাচর পাওয়া যেত না। পাওয়া গেলেও দাম ছিল নাগালের বাইরে। কিন্তু এখন প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। দামেও সাশ্রয়ী। কাওসার আহমেদ নামের আরেক ক্রেতা জানান, দেশি মাছগুলো খেতে সুস্বাদু এবং দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় তিনি নিয়মিত এসব মাছ কেনেন।
বাণিজ্যিক মাছের পাশাপাশি দেশি মাছ চাষে অনেকে আগ্রহী হচ্ছেন জানিয়ে নেত্রকোনা সদরের মাছচাষি নুরুল আমিন বলেন, দেশি মাছের বাজারে চাহিদা থাকায় এবং বাজারমূল্য ভালো থাকায় স্বল্প পুঁজিতে ভালো লাভ হয়। ফলে এখন অনেকেই এসব মাছ চাষে ঝুঁকছেন।
ময়মনসিংহের ত্রিশালের দ্য এম ও অ্যাগ্রো ফিশারিজের মালিক কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, দেশি প্রজাতির পাবদা এবং গুলশা প্রতি শতাংশে ২২০টি, পুঁটি মাছ ৩০০, ট্যাংরা ২৫০, শিং ও মাগুর ৪৫০টি করে চাষ করা সম্ভব। এসব মাছ ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়। প্রতি কেজি মাছ উৎপাদনে তাঁদের সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা খরচ হয় এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করায় রোগবালাইয়ের প্রকোপ নেই বললেই চলে।
মাছ উৎপাদনের চিত্র
মৎস্য ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ৯২৬টি হ্যাচারি আছে। যেখানে মাছ ও চিংড়ির রেণু উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে সরকারি হ্যাচারি ১০২টি এবং বেসরকারি ৮২৪টি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বছরে মোট রেণু উৎপাদনের পরিমাণ ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৫৪ কেজি। এর মধ্যে বেসরকারি হ্যাচারি উৎপাদন করে ৬ লাখ ৭৪ হাজার ৬৯৫ কেজি এবং সরকারি হ্যাচারি উৎপাদন করছে মাত্র ১২ হাজার ৫৯ কেজি রেণু। এর মধ্যে শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে ২০০ কোটি পাবদা ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে মাঠপর্যায়ে পাবদা, গুলশা, শিং, ট্যাংরা, মাগুর, কই ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। ইদানীং বাটা মাছের চাষও বাড়ছে।
দেশে মোট উৎপাদনের মাত্র ১৬ শতাংশ (৬ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন) হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ। বাকি ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন অর্থাৎ ৮৪ শতাংশই মিঠা পানির মাছ। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে দেশে মাছের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন। মৎস্য উৎপাদনে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ছোট মাছ দিয়ে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের পুনরুৎপাদনের জন্য গবেষণা কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়ায় জিন সংরক্ষণ, প্রজননের কৌশল উদ্ভাবন এবং চাষাবাদ পদ্ধতির প্রক্রিয়া জানা সম্ভব হয়েছে। মাঠপর্যায়েও এই মাছের পোনা বিতরণ করা হয়েছে; যা বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক হারে চাষ হচ্ছে।