দেশি মাগুর মাছ চাষ ও রেণু পোনা উৎপাদন পদ্ধতি মৎস্য খামারিদের আগ্রহের বিষয় । এই মাছ একটি আতি পুষ্টি সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু প্রকৃতির মাছ। দেশি মাগুর মাছ চাষ বর্তমান সময়ে ব্যাপক জনপ্রীয় হয়ে উঠেছে। মাগুর মাছ চাষ করার পদ্ধতিও এখন সকল মাছ চাষীর জানা। দেশি মাগুর মাছের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। এক সময় আমাদের দেশে এই মাছটি সহজেই প্রাকৃতিক জলাশয় ও খাল বিলে পাওয়া যেত।
কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশি মাগুর আর তেমন পাওয়া যায় না। বলতে গেলে মাছটি প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। আশার কথা হলো আমাদের দেশের মাছ চাষিরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এই মাগুর মাছটিকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। দেশি মাগুর মাছের দাম তুলনামুলক অনেক বেশি থাকে সবসময়।
দেশি মাগুর মাছ চাষ করার পদ্ধতি
যে সব দেশীয় জাতের মাছ সহজে অন্য যে কোন মাছের সাথে মিশ্রভাবে চাষ করা যায়, তাদের মধ্যে মাগুর মাছ অন্যতম। স্বাদে ও পুষ্টিগুনে এই মাছ অতুলনীয়। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় ১৯৮৯ সালে প্রথম আমাদের দেশে থাইল্যান্ড থেকে আফ্রিকান হাইব্রীড জাতের মাগুর
আমদানি করার পর থেকে আস্তে আস্তে দেশি মাগুর মাছ চাষ করার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। বিদেশি জাতের মাগুর যে কোন পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে, এবং কম খরচে অধিক উৎপাদন করা যায় বলে চাষীরা আফ্রিকান এই মাগুরের চাষে ঝুঁকে পরছেন।
আমাদের সকলের এখন করনীয় আফ্রিকান মাগুরের চাষ থেকে বেরিয়ে এসে দেশি মাগুর মাছ চাষ করা।
দেশি মাগুর মাছ চাষ (মিশ্র পদ্ধতি)
কার্প মাছ, তেলাপিয়া মাছ, পাঙাশ মাছ, পাবদা-গুলসার সাথে শতকে ১৫-২০ টি করে দেশি মাগুর খুব সহজে চাষ করা যায়। শিংমাছ চাষের সাথে শতকে ১০০ টি করে দেশীয় জাতের মাগুর চাষ করা যায়। এটি মুলত পানির নীচু স্তরের মাছ। এরা কাঁদা থেকে বিভিন্ন পোঁকা-মাকড় খেয়ে থাকে। এ মাছের জন্য ৩০% সম্পূরক খাবার সরবরাহ করার প্রয়োজন হয়।
এরা পুকুরের অনেক বিরুপ পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। পানির পরিবেশ ঠিক রাখতে পারলে এই মাছ সহজে কোন রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হয়না। কেউ চাইলে মাগুরের একক চাষও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে শতকে ২০০-৩০০ টি করে মাগুরের পোনা দিতে পারেন।
মিশ্র পদ্ধতিতে মাগুর চাষে ৮-৯ মাসে প্রতিটি মাছ ১৫০-২০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হতে দেখা যায়। আর একক চাষে ৬-৭ মাসে ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। মিশ্রচাষে মাগুর মাছের জন্য আলাদা কোন খাবার দিতে হয়না এবং আলাদা কোন পরিচর্যাও করতে হয়না। আমাদের দেশের অনেক হ্যাচারী তেই দেশীয় মাগুরের রেনু ও পোনা পাওয়া যায়।
দেশী মাগুর মাছের রেনু উৎপাদন পদ্ধতি
প্রতি শতাংশ পুকুরে ৫০-১০০ টি দেশি জাতের মাগুর মাছ মজুত করতে হবে। সাধারণত দেশি জাতের মাগুর এক বছরেই প্রজননক্ষম হয়ে থাকে। কৃত্রিম প্রজননের জন্য সুস্থ সবল ও পেট ভর্তি ডিম দেখে স্ত্রী মাছ নির্বাচন করতে হবে। উন্নত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকেই মাগুর মাছ প্রজনন করানো যায়।
দেশি মাগুর মাছ চেনার উপায়
প্রজননের সময় পুরুষ ও স্ত্রী মাগুর মাছগুলো কে সহজেই সনাক্ত করা যায়। দেখা যায় স্ত্রী মাগুর মাছ একটু কালচে বর্ণের হয় এবং প্রজনন মৌসুমে এদের পেট ভর্তি ডিম থাকে। আর পুরুষ মাছের পেট স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে এবং পুরুষ মাগুর মাছের রং দেখতে হালকা বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। দেশি মাগুর মাছ চাষ করতে এর চেনার উপায় জানতে হবে।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে পানির তাপমাত্রা ২৭-২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট এর বেশি হলে দেশি মাগুরের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়েও পরে বাচ্চা মারা যায়। এভাবে ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পর বাচ্চাগুলো আপনা আপনি সিস্টার্নের কোণায় যেতে থাকবে। সিস্টার্নের কোণায় অবস্থান নিলেই সাধারণত বাচ্চার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যায়। বাচ্চাগুলো কোণায় অবস্থান নিলে সিস্টার্নের মাঝখানের ময়লা, ধূলাবালি সাইফনের মাধ্যমে পরিষ্কার করে দিতে হবে।
এভাবে উৎপাদিত মাগুর মাছের বাচ্চার বয়স ৭২ ঘণ্টা পার হলেই এদেরকে কৃত্রিম খাবার দিতে হবে। এই সময় খাদ্য হিসাবে ছোট ছোট জু-প্যাংকটন জীবিত অবস্থায় সিস্টার্নে দিতে হবে।
এই সকল জু-প্যাংকটন পুকুর থেকে জীবিত অবস্থায় ধরে সংগ্রহ করে তারপর সিস্টার্নে দিতে হবে। সিস্টার্নে দুই দিন এই খাবার খাওয়ানোর পর নার্সারি পুকুরে নার্ছিং করার জন্য স্থানান্তর করতে হবে।
দেশি মাগুরের পোনা কীভাবে উৎপাদন করতে হয়
পুকুর নির্বাচন
দেশি মাগুরের পোনা উৎপাদনের জন্য তলা শুকানো সাধারণত ১৫-২০ শতাংশের আয়তাকার পুকুর হলে ভাল হয়। প্রজনন মৌসুমের আগেই পুকুর শুকিয়ে যায় এমন পুকুর নির্বাচন করতে হবে। পুকুরের তলা ৮-১০ ইঞ্চি বা তারচেও বেশি ঢালু হওয়া দরকার।
পুকুর তৈরী
দেশি মাগুরের রেনু থেকে পোনা উৎপাদনের জন্য পুকুর তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুকুর তৈরিতে কোনো ত্রুটি বা ভুল থাকলে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন বা ফল পাওয়া যাবে না।
পুকুরের তলায় পানি থাকলে প্রথমেই তা সেচে ফেলতে হবে। এরপর শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন পানির সাথে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর রোদে শুকিয়ে পুকুরের চারপাশ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করতে হবে।
পুকুরের পাড়ে শক্ত জাল দিয়ে ভালভাবে বেড়া দিতে হবে। মাটি থেকে এ নেট বা জালের উচ্চতা হবে কমপক্ষে চার ফুটের। স্যালো মেশিন দিয়ে ১ ফুট থেকে ১.৫ ফুট পরিষ্কার পানিত পুকুরে ঢুকাতে হবে।
পুকুরে পানি ভর্তি করা
এসময় একটি কথা অবশ্যই সকলকে মনে রাখতে হবে, অপরিষ্কার পানি কিছুতেই পুকুরে প্রবেশ করানো যাবে না এবং ১ ফুট থেকে ১.৫ ফুটের বেশি পানিও দেয়া যাবে না। অনেক মৎস্য খামারি ২-৩ ফুট পানির মধ্যে রেনু ছাড়েন। এতে দশ ভাগের একভাগ পোনাও তারা উৎপাদন করতে পারে না। এটি হয় শুধুমাত্র পানির উচ্চতার কারণে।
দেশি মাগুরের রেনু থেকে পোনা উৎপাদন করতে নার্সারি পুকুরের পানির উচ্চতা ১ ফুট বা তার চেয়ে কম হলে সবচেয়ে ভাল উৎপাদন হয়। আর পানির উচ্চতা যদি বেশি হয়, মাগুর মাছের পোনা ১-১.৫ ইঞ্চি সাইজ হওয়ার পর চিকন হতে থাকে এবং মাথা পানিতে লম্বালম্বিভাবে খাড়া করে দিয়ে স্থির থাকতে দেকা যায়। পরবর্তীতে দেখা যায় মাছের পোনা ব্যাপকহারে মারা যায়।
অনেক খামারিরা একে মাগুর মাছের রোগ মনে করে বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষুধ প্রয়োগ করে তাকে। কিন্তু এতে করে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এর প্রধান কারণ দেশি মাগুর মাছ বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকে। আর তাই বারবার বেশি পানির উচ্চতায় এসে অক্সিজেন নিতে গিয়ে মাছের কায়িক পরিশ্রম বেশি হয়, এতে এক সময় মাছ খুব দুর্বল হয়ে খাবার ছেড়ে দেয় এবং পরবর্তীতে মাগুর মাছের পোনাগুলো মারা যায়। এ ঘটনা বেশির ভাগ ঘটে সাধারণত রেনু ছাড়ার প্রথম এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে।
পানির পরিমান
দেশী মাগুরের রেনুর সাইজ যখন এক ইঞ্চি বা তারচেয়ে একটু বড় হয় তখন অনেকে ভাবতে পারেন কম পানিতে দেশি মাগুর বাঁচাবে কিনা? এর উত্তর হলো, আমাদের দেশে মে, জুন ও জুলাই মাসে মাগুরের পোনা উৎপাদনের সময় রোদের তাপমাত্রা এত বেশি থাকে যে পুকুরের তলা পর্যন্ত সূর্যের তাপে গরম হয়ে যায়। এ সময়ে দু’টি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- পুকুরের এক পাশের পানির উচ্চতা আরেক পাশের চেয়ে ১ ফুটের বেশি বা ঢালু রাখতে হয়। অর্থাৎ এ পাশের পানির উচ্চতা ১ ফুট হলে অন্যপাশের উচ্চতা হবে প্রায় ২ ফুট থাকে। এতে প্রচন্ড রোদ্রের সময় দেশি মাগুরের রেনু গরম থেকে বাঁচার জন্য নিজে নিজেই পুকুরের গভীর অংশে চলে যায়। আবার রাতে তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে কম পানির উচ্চতায় রেনু পোনা চলে আসবে।
- কচুরীপানা দিয়েও পুকুরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে পুকুরের ৪-৫টি জায়গায় কচুরীপানা দিয়ে ৫ ফুট ব্যাসের বৃত্তাকার শেড তৈরি করতে হবে।
দেশি মাগুর মাছের খাবার প্রয়োগ পদ্ধতি
মাগুর মাছের নার্সারি পুকুরে রেনু ছাড়ার পর খাদ্য হিসেবে সাধারণত ডিমের কুসুম ও গমের আটা মিশিয়ে খাবার হিসেবে প্রয়োগ করতে হয়। মাগুর মাছের খাদ্য তালিকা- এক্ষেত্রে ২০ শতাংশ পুকুরের জন্য ২০ টি হাঁসের ডিম সিদ্ধ করার পর তা পানি ও ব্লেন্ডারের সাহায্যে ব্লিন্ড করতে হবে। এবং তা কাপড় দিয়ে ছেকে নিতে হবে। এরপর ফুটন্ত পানি চুলা থেকে নামিয়ে ওই পাতিলে ১ কেজি পরিমান গমের আটা মিশিয়ে ভাল করে নাড়াচাড়া করে দিতে হবে।
এখানে খেয়াল রাখতে হবে যেন আটা পাতিলের তলায় লেগে বা জমে না থাকে। আটা পাতিলের তলায় লেগে এবং তা পুড়ে গেলে এটি মাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আটা গরম পানির সাথে ভালভাবে মেশানোর পর টিওবওয়েলের পরিষ্কার পানি মিশিয়ে তা ভালোভাবে ঠান্ডা করতে হবে।
তারপর পানিতে মেশানো ডিমের কুসুমের সাথে আটা মেশানো পানি এক করে গুলিয়ে মাগুর মাছর খাবার হিসেবে পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। সন্ধ্যার পর একবার, রাত ১২ টার সময় একবার এবং ভোরে একবার। এভাবে মোট ৩ বার পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। দিনের বেলায় মাগুর মাছের পোনা খেতে চায় না তািই দিনে খাবার না দেয়াই ভাল। এভাবে ৫-৬ দিন খাবার দেয়ার পর ৬ দিন পর থেকে কৈ মাছের নার্সারি ফিড মাগুরকে দেয়া যেতে পারে। ৩০ দিনের মধ্যেই প্রায় ৩ ইঞ্চি সাইজের পোনা হয়ে গেলে চাষের পুকুরে পোনা স্থানান্তরিত করতে হবে।