নিলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্র সৈয়দপুরের বিজ্ঞানীরা একের পর এক সাফল্য অর্জন করে চলেছেন। গবেষণায় বিলুপ্ত প্রায় মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছেন তারা।
গুতুম, টেংরাসহ অন্যান্য বিলুপ্ত প্রায় মাছের পোনা উৎপাদনের পর এবার জারুয়া মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
কেন্দ্রের একদল বিজ্ঞানী এ মাছটি রক্ষায় ২০১৮ সাল গবেষণা শুরু করেন।
অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। জারুয়া মাছের গবেষণায় সাফল্য পাওয়ায় ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি মৎস্য হ্যাচারিগুলোতে জারুয়া মাছের পোনা প্রাওয়া সহজতর হবে বলে ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে।
কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আজহার আলীর নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন, ইশতিয়াক হায়দার, শ্রীবাস কুমার সাহা, তাশরিফ মাহমুদ মিনহাজ এ গবেষণায় অংশ নেন।
জারুয়া মাছ মূলত বাংলাদেশের মিঠাপানির একটি মাছ। মাছটির (বৈজ্ঞানিক নাম Chagunius chagunio)। দেশের উত্তর জনপদে মাছটি উত্তি নামে পরিচিত। মিঠাপানির জলাশয় বিশেষ করে পাথুরে তলদেশ ও অগভীর স্বচ্ছ নদী এদের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মাছটি সুস্বাদু, মানবদেহের জন্য উপকারী অণুপুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং উত্তরাঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক সময় মাছটির প্রাচুর্য ছিল। উত্তর জনপদে মাছটির প্রচুর চাহিদা। কিন্তু জলাশয় দূষণ অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, নদীতে বানা ও কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং চৈত্র মাসে জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরাসহ নানা কারণে বাসস্থান ও প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় এ মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। এজন্য প্রজাতিটিকে বিপন্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে গবেষণা করা হচ্ছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর গবেষণা চালিয়ে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনের কলাকৌশল উদ্ভাবনে সাফল্য পেলেন বিজ্ঞানীরা।
ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, জারুয়া মাছের প্রধান প্রজননকাল জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রজনন মৌসুমের এক-দুই মাস আগেই নদ-নদী, বিল, হ্রদ ইত্যাদি থেকে সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের জারুয়া মাছ সংগ্রহ করে আগে প্রস্তুতকৃত পুকুরে শতাংশে ১৫০টির সঙ্গে দুটি কাতলা, দুটি সিলভার কার্প, তিনটি রুই এবং তিনটি রাজপুঁটি মজুদ করে এক-দুই মাস প্রতিপালন করে প্রজনন উপযোগী ব্রড মাছ উৎপাদন করা যায়।
মজুদকৃত মাছগুলোকে প্রতিদিন দেহ ওজনের পাঁচ-তিন শতাংশ হারে ৩০% প্রোটিনসমৃদ্ধ সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে। নিয়মিত পানির গুণাগুণ যেমন তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া ও মোট ক্ষারত্বের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মজুদের পর থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছের দেহের বৃদ্ধি ও পরিপক্কতা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে পুকুরে এয়ারেটর ব্রড স্থাপন করা যেতে পারে।
একটি পরিপক্ক মা মাছ থেকে বয়স ও ওজন ভেদে প্রতি ১০০ গ্রাম দৈহিক ওজনের জন্য ১২,০০০–২২,১৭৫টি ডিম পাওয়া যায়। মাছটি প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার এবং ২৫০-৩০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে, তাহলে অঞ্চল ভেদে ১৫০-২০০ গ্রাম থেকেই স্ত্রী মাছ প্রজননক্ষম হতে শুরু করে।
সিস্টার্নে স্থাপনকৃত হাপায় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিশ্চিত করতে কৃত্রিম ঝর্ণা ব্যবহার করা হয়। প্রজননের জন্য জারুয়া মাছের স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে কৃত্রিম হরমোন ওভোহোম দ্রবণ বক্ষ পাখনার নিচে ইনজেকশন হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। জারুয়া মাছের কৃত্রিম প্রজননে একক মাত্রার হরমোন ইনজেকশন প্রতি কেজি পুরুষ মাছকে ০.৫ মিলিলিটার হারে এবং স্ত্রী মাছকে ২.০ মিলিলিটার হারে প্রয়োগ করা হয়।
হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের ১৮-২০ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছকে চাপ দিয়ে ডিম বের করা হয় এবং পুরুষ মাছের স্পার্ম বের করে ০.৯% লবণ পানির সঙ্গে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করা হয়। ওই দ্রবণ ডিমের সঙ্গে মিশিয়ে পাখির পালক দিয়ে দুই-তিন মিনিট নাড়ানো হয় এবং ফ্রেশ পানি দিয়ে ধুয়ে ট্রেতে কৃত্রিম ঝর্ণায় স্থানান্তর করা হয়। ডিম ছাড়ার ৮০-১০৪ ঘণ্টা পর ডিম থেকে রেণু বের হয়। রেণু বের হওয়ার ৭২ ঘণ্টা পর থেকে রেণুকে খাবার দিতে হবে। রেণু পোনাকে সিদ্ধ ডিমের কুসুমের দ্রবণ দিনে ছয় ঘণ্টা পর পর চার বার দিতে হবে। হাপাতে রেণু পোনাকে এভাবে সপ্তাহব্যাপী রাখার পর নার্সারিতে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হয়। ছোট পুকুর (এক-পাঁচ শতক) নার্সারি হিসেবে ব্যবহার করা যায় এবং সঠিক পরিচর্যায় ৫০-৬০ দিনের মধ্যে আঙুলি পোনা বা চারা পোনায় (Fingerlings- বলতে মানুষের আঙুলের সমান) পরিণত হয়।
কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আজহার আলী জানান, বিলুপ্ত প্রায় এ মাছটি খানসামার জয়গঞ্জ এলাকার আত্রাই নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়। এরপর দীর্ঘ গবেষণার পর কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা আসে। আমরা প্রযুক্তি হেড অফিসে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে মৎস্য বিভাগের মাধ্যমে চাষি পর্যায়ে যাবে জারুয়া মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের কৌশল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, দেশের মৎস্য উৎপাদনে দেশীয় ছোট মাছের অবদান ৩০-৩৫%। দেশীয় মাছের চাষাবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের মানুষ এর সুফল পাচ্ছে। জারুয়া মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা এতে নতুন সংযোজন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে এবং দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সক দেশীয় মাছকে পুনরুদ্ধার করার জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
সূত্র.বাংলানিউজ২৪.কম।