চলতি মৌসুমের প্রথম চার মাসে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদ থেকে রেকর্ড পরিমাণ মাছ আহরণ করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৭৩ টন মাছ এসেছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) চারটি বিপণন কেন্দ্রে। এর বিপরীতে ১১ কোটি ৩৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা রাজস্ব আয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত মৌসুমে এসেছিল ৫ হাজার ৫০৪ টন মাছ। এ থেকে বিএফডিসি শুল্ক আয় করেছিল ১১ কোটি ২৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
বিএফডিসির বিপণনে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কাপ্তাই হ্রদ থেকে আহরিত মাছ রাঙ্গামাটির তিনটি ও খাগড়াছড়ির একটিসহ চারটি বিপণন কেন্দ্রে রাজস্ব আহরণ শেষে বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। বিপণন কেন্দ্রে আসা মাছের সবই পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বিগত সময়ে বিএফডিসির অসাধু কর্মীদের যোগসাজশে সব মাছের শুল্ক পরিশোধ না করেই চালান করা হতো। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চালান দেয়া মাছের রেকর্ড জমা হতো না। এ কারণে বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় ভাটা দেখা যেত।
রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার এ অভিযোগ বহু আগে থেকেই রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অসাধু কর্মীদের লাগাম টেনে ধরায় মাছ পরিবহন ও বাজারজাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে বলে দাবি করছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। অবতরণ ও শুল্কহার বাড়ার কারণ হিসেবে শৃঙ্খলার কথা তুলে ধরছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছরের ১ মে থেকে ৩১ জুলাই কৃত্রিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা দেয় জেলা প্রশাসন। চলতি বছর হ্রদের পানি অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের ১২ দিন আগেই বন্ধ করা হয় মাছ আহরণ। আবার তিন মাসের নির্ধারিত সময়ে হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না বাড়ায় দুই দফায় আরো ১ মাস ১২ দিন বন্ধের সময় বাড়ানো হয়। ৪ মাস ১২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে হ্রদে ফের মাছ আহরণ শুরু হয়।
রাঙ্গামাটি শহরের প্রধান বিপণন কেন্দ্র ছাড়াও কাপ্তাই, মারিশ্যা ও খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে উপবিপণন কেন্দ্র রয়েছে বিএফডিসির। চারটি কেন্দ্রে হ্রদের মাছ অবতরণ ও শুল্ক আদায় শেষে বাজারজাত করা হয়। সবচেয়ে বেশি মাছ আসে প্রধান বিপণন কেন্দ্রে।
স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, রাঙ্গামাটির রাজস্থলী ও কাউখালী ছাড়া বাকি আট উপজেলা ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালা এবং মহালছড়ি উপজেলা মিলে কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার নিবন্ধিত জেলে। মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলতি বছর হ্রদে পানিস্বল্পতার কারণে দেরিতে আহরণ শুরু হওয়ায় মাছের আকার বেড়েছে। সুষম বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক প্রজননের জন্য সময় বাড়ার কারণে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার মাছ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক কমান্ডার মো. আশরাফুল আলম ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রায় ৭২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের হ্রদে প্রতি বছরই মাছ উৎপাদন কমার বিষয়টি শুনে আসছি। বিএফডিসি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। এজন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আমরা চলতি বছর উৎপাদনে জোর দিয়েছি। হ্রদে গত অর্থবছরের সমপরিমাণ মাছ উৎপাদন হয়েছে চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই। গত বছর এ সময়টায় আমাদের মাছের দৈনিক অবতরণ ছিল সাত-আট টন। এ বছর সেটি ন্যূনতম ২০ টনে দাঁড়িয়েছে। এতে ধরে নেয়া যায় হ্রদে মাছ উৎপাদন বেড়েছে। আমরা আশাবাদী, এ ধারা অব্যাহত থাকবে এবং জেলে-ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হবেন।’
উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূলত আমরা মাছ অবতরণ ব্যবস্থাপনাকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পেরেছি। এ শৃঙ্খলা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি ভবিষ্যতেও মাছ উৎপাদন বাড়বে।’
ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার ফলে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। প্রায় ৭২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ হ্রদ জলবিদ্যুৎ ও মৎস্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের সুষম বৃদ্ধি, মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিতসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রতি বছরের ১ মে-৩১ জুলাই পর্যন্ত তিন মাস মাছ আহরণ বন্ধ থাকে। এ সময় হ্রদের মাছ বাজারজাত এবং স্থানীয় বরফকলগুলোও বন্ধ থাকে। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে নৌ-পুলিশের পাশাপাশি বিএফডিসির কর্মকর্তারা মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
সূত্র: বণিক বার্তা।