১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে সুন্দরবনে মধু আহরণের মৌসুম। চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত টানা দুই মাস। জঙ্গলের গহিনে মৌচাকে মধু জমায় মৌমাছি। আর মৌমাছির কষ্টের ধন ‘মধু’ বনে-জঙ্গলে ঘুরে খুঁজে বের করেন একদল মানুষ। তাঁদের বলা হয় ‘মৌয়াল’। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল এই মৌয়ালেরা চলতি মৌসুমে বাঘ, সাপ-কুমিরের ভয় উপেক্ষা করে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মৌয়ালেরা কীভাবে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করেন, এই প্রতিবেদক তাঁদের সঙ্গী হয়েছিলেন।
খুলনার সর্বদক্ষিণের সুন্দরবনঘেরা সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা কয়রা। কয়রার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদীর ওপারে সুন্দরবন। এপারে লোকালয়। ৭ এপ্রিল ভোরের আলো ফুটতেই আমাদের যাত্রা শুরু হয় কয়রা উপজেলার বীণাপাণি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদী থেকে। ছোট একটি ডিঙিনৌকায় আমরা সাতজন। তার মধ্যে পাঁচজনই মৌয়াল। বীণাপাণি গ্রামের মৌয়াল গোবিন্দ, বিপ্লব কুমার, পরিমল কুমার, মনোরঞ্জন ও দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সঙ্গে গল্পে গল্পে এগোতে থাকে নৌকা। সবাই বংশপরম্পরায় সুন্দরবনের মধু ও মাছ সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত। বনের মধ্যের ছোট খাল দিয়ে এঁকেবেঁকে নৌকাটি চলে যায় গহিন বনের মুচির খালে।
খালের পাড়ে একটি গেওয়া গাছের সঙ্গে নৌকা বাঁধা হয়। বনের মধ্যে তখন জোয়ারের পানি বাড়ছে। বনের ভেতরে প্রায় এক হাত পানি আর পানির নিচে শ্বাসমূল। শ্বাসমূল যেন পায়ে না ফুটে যায়, তাই বনে পা ফেলার আগে বিশেষ প্লাস্টিকের জুতা পরে নেন সবাই। মৌমাছির চাক কেটে মধু সংগ্রহের জন্য নৌকা থেকে নামিয়ে নেওয়া হয় দা ও বড় ড্রাম। মৌমাছির হুলের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য চোখ বাদে পুরো মুখমণ্ডল গামছা ও নেট জাল দিয়ে আবৃত করে নেন মৌয়ালেরা।
বনের মধ্যে হেঁটে হেঁটে মৌচাক খোঁজাকে মৌয়ালদের ভাষায় ‘ছাটা’ দেওয়া বলে। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মৌয়ালদের অনুসরণ করে হাঁটা বেশ কঠিন। কারণ শ্বাসমূল, আঠালো কাদা, কোথাও হাঁটুপানি, আবার কোথাও বুকসমান পানি। এক হাতে ক্যামেরা উঁচিয়ে ধরে এর মধ্যেই এগিয়ে চলছিলাম। হঠাৎই জঙ্গলের ভেতর থেকে কিসের যেন হাঁটার শব্দ শুনতে পেলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য ভয়ে থমকে দাঁড়াই। পরক্ষণেই দেখলাম পাশের গোলপাতা ঝাড়ের পাশ দিয়ে একটি বন্য শূকর দৌড়ে পালাল।
ঘণ্টাখানেক এভাবে ঝোপ-জঙ্গল আর কাদা-পানি পেরিয়ে হাঁটার পর মৌয়ালেরা লম্বা গেওয়াগাছের ডালে একটি চাক খুঁজে পেলেন। কাছে যেতেই কিছুটা দূর থেকে মৌয়াল দেবেন্দ্রনাথ আঙুল উঁচিয়ে দেখান মৌচাকটি। চোখের সামনে মৌচাকের দেখা মিলতেই উবে গেল পায়ে শ্বাসমূল আর গায়ে গাছের খোঁচা খাওয়ার ব্যথা। মৌয়াল মনোরঞ্জন সতর্ক করে দিলেন, যাতে কেউ উচ্চ শব্দে কথা না বলি, তাতে মৌমাছির আক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যাবে।
সবাই প্রস্তুত হয়ে গেলেন চাক কাটার জন্য। মৌয়ালেরা শুকনা পাতা জোগাড় করে একত্র করতে লাগলেন আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করার জন্য। একে তাঁরা ‘কাড়ু’ বলে থাকেন। তাঁরা দক্ষ হাতে শুরু করলেন ‘কাড়ু’ তৈরির কাজ। হুদো নামের একধরনের লম্বাটে শুকনা গাছ আর তার চারপাশে কাঁচা গোলপাতা দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হলো সেটি। মৌয়ালেরা জানালেন, শুকনো পাতাগুলো আগুন জ্বলতে সহায়তা করে আর কাঁচা পাতাগুলো ধোঁয়া তৈরি করে।
ঠিক হলো মৌয়াল গোবিন্দ, পরিমল ও আমি যাব চাক কাঁটতে। বাকিরা নিরাপদ দূরত্বে থাকবেন। মৌমাছি যেন হুল ফুটিয়ে দিতে না পারে, এ জন্য আমি পরে নিয়েছিলাম রেইনকোট। মাথা একটি নেট জাল দিয়ে ঢেকে নিলাম। কাড়ুতে আগুন দিতেই ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়ে গেল এলাকা। এরপর সেটি নিয়ে সামনে সামনে চললেন গোবিন্দ। তাঁর পেছনে পরিমলের কাঁধের সঙ্গে ঝোলানো একটি নীল রঙের প্লাস্টিকের ড্রাম, তার মধ্যে আছে একটি দা। ড্রামটি ঝুলিয়ে নেওয়ার সুবিধার জন্য দুই পাশে চারটি ফুটো করে দড়ি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শ্বাসমূল আর কাদাপানি সামলে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম মৌচাকের গাছের নিচে। মৌয়াল গোবিন্দ তরতর করে উঠে গেলেন গাছের ওপর। পরিমলের সহযোগিতায় গাছের ওপর পৌঁছে দেওয়া হয় ড্রাম, চাক কাটার দা ও কাড়ু। গাছের ওপর উঠে মৌচাকের ঠিক নিচে কাড়ুর ধোঁয়া ধরলেন গোবিন্দ। মুহূর্তেই মৌমাছিরা বন বন করে উড়তে শুরু করে। গাছের নিচে কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে থাকা পরিমল মণ্ডল ও আমাকে ঘিরে ধরল একঝাঁক মৌমাছি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৌমাছির হুলে নাজেহাল অবস্থা পরিমলের। আমার গায়ে রেইনকোট থাকায় কোনো সমস্যা হয়নি। তবে পরিমল মৌমাছির হুল ফোটানো থেকে বাঁচতে পানিতে ডুব দিলেন। তাতেও মৌমাছির হাত থেকে রক্ষা পাননি তিনি। পড়িমরি করে লাফিয়ে পড়লেন পাশের খালে।
ওদিকে গাছের ওপরের চাক থেকে মৌমাছি সরে যেতেই মধুসমৃদ্ধ চাক ফুটে ওঠে চোখের সামনে। পুরো চাকের তিন ভাগের মাত্র এক ভাগে রয়েছে মধু। এক পাশে মৌমাছির বাসা, আরেক পাশে ফুল থেকে সংগ্রহ করা মধু। আর মধুর নিচে থাকে আরেকটা অংশ, যাকে গুটলি (ফুলের পরাগরেণু) বলে। সেই অংশটাই প্রথমে কেটে ফেলে দিলেন মৌয়াল গোবিন্দ। এরপর মধু রাখার ড্রামটি মৌচাকের নিচে ধরে দা দিয়ে মধুর অংশটা কাটতেই মধুসহ চাকটি পড়ে ড্রামের মধ্যে। মধুর ড্রাম, দা আর কাড়ু নিয়ে গোবিন্দ গাছ থেকে নেমে পড়তেই নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটে যাই আমরা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাই বাকি সদস্যদের কাছে। তখনো ফেরেননি মৌমাছির তাড়া খেয়ে পালানো মৌয়াল পরিমল। মিনিট চারেক পর জঙ্গল থেকে বের হলেন পরিমল। বললেন, ‘হুল ফোটানো থেকে বাঁচতে খালের পানিতে লাফ দিলেও মৌমাছির হাত থেকে রক্ষা পাইনি। আমার পিছু নিয়েছিল শত শত মৌমাছি। ডুব দিয়ে পানির ওপর উঠলেই হুল ফোটাচ্ছিল। পরে ঘন হুদোগাছের ঝোপের ভেতর পালিয়ে বহু কষ্টে মৌমাছির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। ততক্ষণে অনেক হুল ফুটেছে। দেখেন শরীর কেমন ফুলে গেছে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মধুর ড্রাম নিয়ে নৌকায় পৌঁছে যাই। ড্রামের মধ্যে তাকিয়ে চাকসহ টাটকা মধু দেখেই মনটা জুড়িয়ে যায়। মৌয়াল মনোরঞ্জনের দায়িত্ব থাকে মোমসহ চাক চেপে মধু ও মোম আলাদা করার। মধু আর মোম আলাদা হয়ে গেলে মোমটা একটা ব্যাগে আর মধুটা আলাদা এক বোতলে রাখা হয়। এরপর আবার শুরু হয় নতুন চাক খোঁজা।
এভাবে বনের ভেতর তিন–চার ঘণ্টা ঘুরে গহিন বন থেকে চাক খুঁজে মধু সংগ্রহ করা হলো। সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে খালের পানিতেই গোসল করে বনের মধ্যে খেতে বসলেন সবাই। কিছুক্ষণ বনের মধ্যে উঁচু জায়গায় বসে বিশ্রাম নেওয়ার পর জোয়ারের পানি নামতে শুরু করলে আমরা আর সামনে না এগিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের প্রতিটি মুহূর্ত রোমাঞ্চকর। গা ছমছম করা একটা অনুভূতি। সঙ্গে ভয়, কখনো সুন্দর কিছু দেখে আপ্লুত হওয়া। সব মিলিয়ে অন্য রকম রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা।
লোকালয়ে ফিরে কথা হয় সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে সুন্দরবন। ১৮৬০ সাল থেকে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখন যে মধুটা সংগ্রহ করা হচ্ছে, এটা খলিশা ফুলের মধু। এরপর হবে গারণ ফুলের। শেষে আসে কেওড়া, গেওয়া ও অন্যান্য ফুলের মধু। এই কয়েক প্রজাতির মধুর মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু হচ্ছে খলিশার মধু।’ তিনি প্রতিটি মৌচাকের কিছু অংশ রেখে কাটার পরামর্শ দেন। এতে মৌচাকের যে স্থানে ডিম থাকে, সেখান থেকে কিছুটা রেখে বাকি অংশ কাটলে মৌচাকের সংখ্যা আরও বাড়বে, মধুও বেশি হবে।