৮৯
❝ স্মার্ট হলে মৎস্যচাষ, স্মার্ট হবে দেশ ❞
বিভিন্ন মহলে কথিত অভিযোগ ডিজিটাল যুগে ফিশারি অফিসারগণ মাছচাষে পরামর্শ প্রদানে চুনের বাহিরে ভাবতে পারে না, কেন? আমিও সেই চুনে আসক্ত মৎস্য কর্মকর্তা। প্রয়োজনে আমি লবণও সাথে রাখি।
আমি চুন নিয়ে ফেসবুকে ইতিপূর্বে ১৮টি পর্বে লিখেছি। অনেকে ভাবেন চুন তুচ্ছ পদার্থ। সে জন্যই চুন নিয়ে আমার লেখাগুলোকে অনেকে তাচ্ছিল্যভরে অবজ্ঞা করেছেন, অনেকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
আসুন জেনে নিই, চুন ও লবণ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
চুনঃ
চুন অজৈব রাসায়নিক পদার্থ। চুন প্রয়োগে পানির গুণাগুণ বা ওয়াটার কেমিস্ট্রি এর পরিবর্তন হয়। চুন ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামযুক্ত পদার্থ। পানিতে চুন ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে।
চুন প্রয়োগ করলে পানির গুণাগুণ বা প্যারামিটারগুলো যেমন- পিএইচ, কার্বনডাইঅক্সাইড, খরতা, ক্ষারত্ব, ফাইটোপ্লাংক্টন, অক্সিজেন ইত্যাদি পরিবর্তিত হয় অথবা এ প্যারামিটারগুলোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
চুন পানিতে দিলে আয়নায়িত হয়। পানিতে চুন আয়নায়িত হয়ে ক্যালশিয়াম , ম্যাগনেশিয়াম, কার্বনেট, বাইকার্বনেট, হাইড্রোক্সাইড ইত্যাদি আয়নিক অবস্থায় থাকে।
অনুরূপভাবে লবণ পানিতে আয়নায়িত হয়ে সোডিয়াম ও ক্লোরাইড আয়ন অবস্থায় থাকে।
ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম আয়নের সমষ্টিকে হার্ডনেস বা খরতা
এবং কার্বোনেট, বাই-কার্বোনেট, ও হাইড্রোক্সাইডের সমষ্টিকে ক্ষারত্ব বা অ্যালকালিনিটি বলে।
হার্ডনেস বা খরতা (ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম)ঃ
অজৈব উপাদান হিসেবে ক্যালশিয়ামের পরিমাণ প্রাণিদেহে সবচেয়ে বেশি। ক্যালসিয়াম এর ৯৯% হাড় বা কাঁটায় থাকে এবং মাত্র ১% বিপাকে সহায়তা করে।
মাছ ফুলকা দিয়ে পানি থেকে ক্যালশিয়াম শোষণ করে।
অসমোরেগুলেশন নির্ভর করে পানিতে বিদ্যমান মিনারেলের ঘনত্বের ওপর। এই হিসেবে পানিতে ক্যালশিয়ামের ঘনত্ব গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্যের সঙ্গে অতিরিক্ত ক্যালশিয়াম মাছকে খাওয়ালে মাছের জন্য তা ক্ষতিকর।
Cowey(1976) বলেছেন খাদ্যে ম্যাগনেশিয়ামের স্বল্পতা থাকলে এবং ক্যালশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকলে মাছে নেফ্রোক্যালসিনোসিস রোগ হয় এবং মাছের বৃদ্ধি কমে যায়।
রক্তরসে বিদ্যমান ক্যালশিয়াম রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় (Blood clotting) সহায়তা করে।
বিপাক ক্রিয়া বেড়ে গেলে মাছের ক্যালশিয়াম গ্রহণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
Phillips et. al দেখেছেন যে পানিতে ক্যালসিয়ামের ঘনত্ব ৫০ মিলিগ্রাম /লিটার এর নিচে, এর ঘনত্ব যত কম হবে, ক্যালসিয়ামের বিপাক এবং গ্রহণ তত বেশি হবে।
পানিতে ক্যালশিয়ামের ঘনত্ব ১৬-২০ পিপিএম থাকলে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসফরাস থাকলে কার্প মাছের বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবে হয়।
ম্যাগনেশিয়াম স্বল্পতা মাছের ক্ষুধা কমিয়ে দেয়, বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়, অ্যাসের পরিমাণ কমে, লরডোসিস হয়, বিকলাঙ্গতা ও খিঁচুনি হয়, চোখে ছানি পরে এবং মাছের মৃত্যু হয়( Ogino et al., 1978; Satoh et al.,1983a)।
কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য হজমে সহায়তা করে এমন এনজাইম তৈরিতে ম্যাগনেশিয়াম ভূমিকা রাখে।
ফাইটোপ্লাংক্টন বৃদ্ধির জন্য ৫ পিপিএম ক্যালশিয়াম ও ২ পিপিএম ম্যাগনেশিয়াম প্রয়োজন।
মাছের ডিম হার্ডেনিং এ ক্যালশিয়াম ভূমিকা রাখে।
সেলফিশ ও জুওপ্লাংক্টনের বাহ্যিক আবরণ তৈরিতে ক্যালশিয়াম প্রয়োজন।
চুনের ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম পানির কার্বনডাইঅক্সাইড, কার্বোনেট, বাই-কার্বোনেট ও পরোক্ষভাবে ফাইটোপ্লাংক্টন নিয়ন্ত্রণ করে।
পানিতে ক্যালশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকলে মাছে নাইট্রাইটের বিষাক্ততা কমে (Crawford and Allen, 1977)।
ক্ষারত্ব(কার্বনেট, বাইকার্বনেট, হাইড্রোক্সাইড)ঃ
ক্ষারত্বের ওপরই মাছচাষের জলাশয়ের পানির পিএইচ নির্ভর করে। পিএইচ কম-বেশি হলে মাছের উৎপাদন, বৃদ্ধি, রোগবালাই, অ্যামোনিয়া ও নাইট্রাইটের বিষাক্ততা, মাছের মড়ক ইত্যাদি প্রভাবিত হয়।
কার্বোনেট ও বাইকার্বোনেট পানিতে বাফার হিসেবে কাজ করে।
ক্ষারত্ব পানিতে ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।
কার্বনকে প্রাণীদেহের বিল্ডিং ব্লক বলা হয়। ক্ষারত্ব মাছের শরীরে কার্বন সরবরাহ করে।
চিংড়ির শরীরের আবরণের কাইটিন তৈরিতে কার্বন সরবরাহ করে।
লবণঃ
রক্তরস ও এক্সট্রাসেলুলার রসের প্রধান ইলেক্ট্রোলাইট উপাদান সোডিয়াম ও ক্লোরিন।
একটি সোডিয়াম আয়ন মাছের শরীর থেকে একটি অ্যামোনিয়াম আয়ন বের করে দেয়।
জলাশয়ে নাইট্রাইটের পরিমাণ বেরে গেলে ক্লোরাইড আয়ন মাছের শরীরে নাইট্রাইট প্রবেশে বাধা প্রদান করে। অর্থাৎ ক্লোরাইড আয়ন নাইট্রাইটের বিষাক্ততা কমিয়ে দেয়।
মাছে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষায়, অ্যামোনিয়া ও নাইট্রাইটের বিষাক্ততা দূরকরণে লবণ গুরুত্বপূর্ণ।
সুতরাং উল্লিখিত কার্যসম্পাদন বিবেচনায় মাছচাষে চুন ও লবণ মৎস্য কর্মকর্তাগণের সাথেই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক ।
তবে বহু কর্মে উপযুক্ত এই চুন ও লবণ ব্যবহারে মৎস্য কর্মকর্তা তথা মৎস্য চাষিগণকে পারদর্শী হতে হবে।
প্রয়োজন, সময়, পরিমাণ, চুনের ধরন বিবেচনাপূর্বক চুন ও লবণ প্রয়োগে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তবেই স্মার্ট হবে চাষ পদ্ধতি, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ।
বিবিসির বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদদাতা মি.জেমস বার্ক তিনি ১৯৭৩ সালে ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন যে, ভবিষ্যতে অফিসে, স্কুলে, এবং বাড়িতে-বাড়িতে থাকবে কম্পিউটার, যা এখন বাস্তবতা।
চল্লিশ বছর পর তিনি আবারও বলেছেন, ভবিষ্যতে ত্রিমাত্রিক ন্যানো-ফ্যাব্রিকেটর নামের এক প্রযুক্তির এত বিস্তার ঘটবে যে দারিদ্র্য বা অভাব, এগুলো অতীতের বিষয়ে পরিণত হবে।
জেমস বার্ক বলেছেন, “সহজ ভাষায় ন্যানো-ফ্যাব্রিকেটর মানে হলো, কিছু পরমাণু জোড়া দিয়ে অণু বানানো যাবে,
এবং সেই অণুগুলোকে সমন্বিত করে আবার নানা ধরণের জিনিস বানানো যাবে। এর ফলে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অন্য কারো দ্বারস্থ হতে হবে না।
তার যা চাই সবই সে নিজে বানিয়ে নিতে পারবে। জেমস বার্কের এই ভবিষ্যৎবানী সত্য হলে প্রোটিনের চাহিদা মিটানোর জন্য মানুষকে আর মাছচাষ করতে হবে না।
আর মাছচাষ না থাকলে তখনই চুনের প্রয়োজন হবেনা। তাই চুন ও লবণ ছেড়ে দেয়ার জন্য মৎস্য কর্মকর্তাগণকে ন্যানো-ফ্যাব্রিকেটরের আবির্ভাব পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
লেখকঃ মো.আব্দুস ছালাম পি কে, সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, মৎস্য ভবন।