এক সময় গ্রামের মানুষ ইঁদুরে উৎপাতে ঘরে বাইরে অতিষ্ঠ ছিল। এমনকি তাল, নারকেল, সুপারি গাছে ইঁদুরের বাসার কারণে ফল সংগ্রহ করা মুশকিল হয়ে যেত। এখন তেমনটি নেই। তবে শহরে অনেক বাড়িতে ইঁদুরের উৎপাত দেখা যায়। ফলে এখনো রাজধানী ঢাকার তো শহরেও প্রচুর ইঁদুর মারা ফাঁদ ও বিষ বিক্রি হতে দেখা যায়।

ইঁদুরের নাম শুনলেই অনেকের গা ঘিন ঘিন করে। কিন্তু আমাদের দেশের সাঁওতাল আদিবাসীরা কিন্তু ইঁদুর খায়। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও শীতকালে সাঁওতালরা দল বেঁধে ইঁদুর, বেজি, পাখি শিকারের জন্য বের হতো। এখন সেসব আর নেই। আর ইদুর খান এমন আদিবাসীর সংখ্যাও এখন কমে গেছে। ফলে মাংসের জন্য ইঁদুর পালন এই দেশে ভাবাই যায় না। যদিও আফ্রিকার অনেক দেশে ইঁদুরের মাংস বাজারে বিক্রি হয়।

বাংলাদেশে ইদানীং ইঁদুর পালনের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রজাতির ইঁদুর দরকার হয়। এই সুযোগটি আমাদের তরুণ সমাজ নিতে পারেন। যেমনটি করে সফল হয়েছেন রাজশাহীর সালাহউদ্দিন মামুন। তার খামারে এখন ইঁদুরের সংখ্যা হাজারের বেশি।

রাজশাহীর কাটাখালীর সমসাদিপুরের মামুনের খামারের ইঁদুর ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি ল্যাবে।

মানুমের গল্পটা সফলতার হলেও শুরু হয়েছিল একটা ট্র্যাজেডি দিয়ে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণী নিয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এরপর তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় গবেষক হিসেবেও কাজ করেছেন। ঢাকার জীবন ভালো না লাগায় ফিরে যান বাড়িতে। চেষ্টা করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যা হবার তাই হয়েছে। শেষ পর্যন্ত স্নাতকোত্তর পাস মামুন মাধ্যমিকের সনদ দিয়ে একটি চাকরি নেন। বর্তমানে রাজশা্হী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কীটতত্ত্ব ল্যাবের পরিচারক।

২০১৭ সালের শেষ দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের এক পিএইচডি গবেষক চারটি ইঁদুর নিয়ে আসেন। গবেষণা কাজ শেষে তিনি মামুনেরই এক সহকর্মীকে ইঁদুরগুলো দিয়ে কোথাও ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু সুইস অ্যালবিনো প্রজাতির ধবধবে সাদা ছোট ইঁদুরগুলো দেখে মায়ায় পড়ে যান মামুন। সেগুলো বাড়িতে নিয়ে যান। পরিবার  ও প্রতিবেশীরা কিন্তু তাকে পাগল ভাবতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বারান্দার এক কোণে বেষ্টনী দিয়ে ইঁদুরগুলো পালন শুরু করেন। এরই মধ্যে একটি ইঁদুর বিড়াল খেয়ে ফেলে। কিছুদিন পর একটির পেট ফুলে যায়। কয়েক দিন যেতে না যেতেই ইঁদুরটি ১০টি বাচ্চা দেয়। আরেকটি ইঁদুরও কয়েক দিনের মধ্যে আরো ১০টি বাচ্চা দেয়। সেই আনন্দে ইঁদুর পালনে কথা সবাইকে বলে বেড়ান মামুন। আর এভাবেই জানাজানি হয়ে যায়।

এক মাস পর থেকেই তিনি অর্ডার পেতে শুরু করেন। প্রথমে ২০টি ইঁদুর নিয়ে তাকে এক হাজার টাকা দেন। পরে এক শিক্ষার্থী ও গবেষক ২০টি ইঁদুরের জন্য ৮০০ টাকা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মামুনকে। যে গবেষকরা ইঁদুর কিনতেন তাদের কাছ থেকেই ইঁদুর পালনের নানা টিপস তিনি নিতেন ও পেতেন।

মামুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বিভাগে ইঁদুর সরবরাহের পাশাপাশি রাজশাহীর বেসরকারি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েও দেন ইঁদুর। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই সরবরাহ করে মাসে গড়ে সাত–আট হাজার টাকা আয় হয় তার। এখন প্রতিটি ইঁদুর বিক্রি করেন ৭০ টাকায়। ঢাকার বিভিন্ন ফার্মাসিটিউক্যালস কোম্পানিও তার কাছ থেকে ইঁদুর নিচ্ছে।

মামুন তার বাড়িতে একটি খুপরির ভেতরে বেশ কিছু কার্টনে ইঁদুর পালন করেন। সাপ-বিড়াল থেকে তাদের রক্ষা করতে ঘরের চারদিকে শক্ত নেট দিয়ে বেষ্টনী দিয়েছেন। খাবার হিসেবে দেন ব্রয়লার ফিড ও ধান-গম-ভুট্টার দানা।

মামুন জানান, দু-তিন দিন পর পর ঘরটা পরিষ্কার করতে হয়। কার্টনগুলো ওরাই কেটে ফেলে, সেগুলোও পাল্টাতে হয় আট-দশ দিন পরপর। আর মাসে হাজার ইঁদুরের জন্য এক হাজার টাকার খাবার কিনলেই চলে।

সুইস অ্যালবিনো প্রজাতির ইঁদুর আমেরিকায় বছরে ছয়বার মাত্র বাচ্চা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি বছরে ১০ বার পর্যন্ত বাচ্চা দিয়ে থাকে। উৎপাদনের দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময়। আর বিদেশের বিভিন্ন ল্যাবে অনেক চাহিদা থাকায় ইঁদুর রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব

গবেষণাগারে বিভিন্ন গবেষণায় ইঁদুরের চাহিদা বেড়েই চলেছে। সব ওজনের ইঁদুরই গবেষণায় প্রয়োজন হয়। তবে ২০-৩০ গ্রাম ওজনের ইঁদুরের চাহিদা বেশি। আর এক মাস পালনেই গবেষণার জন্য ইঁদুরের এই ওজন পাওয়া যায়। তাঁর কাছে বর্তমানে ১০০টির বেশি মা ইঁদুর রয়েছে