ইলিশের মৌসুম শেষ হওয়ার পথে। অথচ এখনো দেশের নদ-নদীতে ইলিশ যেন একেবারেই অধরা। সাগরে অবশ্য কিছু ইলিশ মিলছে, যার বেশির ভাগই কিনা জাটকা। অর্থাৎ বড় ইলিশ তেমন ধরা পড়ছে না। এতে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের জেলেরা দুর্দশায় পড়েছেন, ব্যবসায়ীরাও হতাশ। বাজারে দাম বেশি বলে সাধারণ ক্রেতারাও ভীষণ ক্ষুব্ধ।
এদিকে প্রজনন মৌসুম সামনে রেখে কদিন পরেই ইলিশ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞার পরপরই শেষ হবে ইলিশের মৌসুম। তখন আবার জাটকা ধরার ওপর আট মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।
বরিশালের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইলিশের চড়া মূল্যের মধ্যে ভারতে রপ্তানির খবরে পাইকারি বাজারেই কেজিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা দাম বেড়েছে। এ নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে। কারণ, ভারতে মাত্রই রপ্তানি শুরু হয়েছে এবং পরিমাণেও খুব বেশি রপ্তানি হবে না।
ইলিশ সংবেদনশীল মাছ। বাসস্থানে পরিবর্তন অনুভব করলে ইলিশ খুব ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তন করে। ইলিশের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রগুলোয় বিভিন্ন উন্নয়ন ও শিল্প প্রকল্প নেওয়ায় নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। এগুলো ইলিশকে পথ পরিবর্তনে বাধ্য করছে।
মীর মোহাম্মদ আলী, চেয়ারম্যান, অ্যাকুয়াকালচার বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বরগুনার ট্রলার মালিক ও জেলে দুলাল মিয়া শনিবার প্রথম আলোকে জানান, লোকসানের কারণে এবার তিনি নিজের একটি ট্রলার বিক্রি করে দিয়েছেন। যৌথ মালিকানায় আরেকটি ট্রলার আছে। সেটি নিয়ে প্রথম দফায় ১০ লাখ টাকার মাছ পেয়েছিলেন। এরপর আরও চারবার সাগরে গেলেও কোনোবার ৫০ হাজার টাকার ওপরে মাছ পাননি। অথচ সাগরে একবার ট্রলার পাঠালে ব্যয় হয় দেড় লাখ টাকা। দুলাল বলেন, ‘ভাবছি, যৌথ মালিকানার ট্রলারটিও বিক্রি করে দেব। লোকসান গুনে সর্বস্বাস্ত হয়ে গেছি। ধারদেনায় জর্জরিত। জানি না, এসব কি দিয়ে শোধ করব।’
পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের বিপণন কর্মকর্তা রিপন হোসেন শনিবার প্রথম আলোকে জানান, এই কেন্দ্রে গত ১ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৯৩ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন ইলিশ এসেছে। আর আগস্টে এসেছিল মাত্র ২৭০ দশমিক ৫ মেট্রিক টন।
এই অবতরণকেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা জানান, গত মৌসুমেও প্রতিদিনই ২২ থেকে ২৫ টন ইলিশ আসত। এবার খুব মাছ কম আসছে, তাই দাম চড়া। এখানে শনিবার প্রতি কেজি রপ্তানিযোগ্য ইলিশ (৬০০–৯০০ গ্রাম) ১ হাজার ৪৫০ টাকা ও এক কেজির বেশি ওজনোর ইলিশ ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বরিশাল পোর্ট রোডের পাইকারি বাজারে শনিবার সব মিলিয়ে দেড় শ মণ ইলিশ এসেছে। এর মধ্যে প্রতি মণ রপ্তানিযোগ্য সাইজের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৫৮ হাজার ও কেজির ওপরের ইলিশ প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৬৬ হাজার টাকায়।
দেশে ইলিশের আরেক বড় মোকাম চাঁদপুরে শনিবার প্রায় ৪০০ মণ ইলিশ এসেছে। সেখানে প্রতি কেজি ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিংবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, এবার ইলিশ উৎপাদনে ধস নেমেছে। ফলে জাতীয় মাছটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
ইলিশ কমার কারণ
মৎস্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভালো ব্যবস্থাপনার ফলে গত এক দশকে দেশে ইলিশ উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছিল। বিশ্বে মোট ইলিশের ৮০ শতাংশই বাংলাদেশে আহরণ হয়। কিন্তু নদ-নদীর গভীরতা হ্রাস, পানিদূষণসহ বিভিন্ন কারণে ইলিশের উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। সে জন্য ইলিশ কম ধরা পড়ার কারণ নির্ণয়ে নিবিড় গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে।
বরগুনার পাথরঘাটার সমুদ্রগামী ট্রলার মালিক আবুল হোসেন ফরাজীর ধারণা, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অনেক চর জেগে ওঠায় স্রোতের বাঁকবদল হয়েছে। এটি সাগরে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ার একটি কারণ হতে পারে।
চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিংবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম মল্লিক বলেছেন, আগে চাঁদপুরে মৌসুমে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ হাজার মণ ইলিশ আসত। এবার তা কমে মাত্র ৩০০-৪০০ মণে নেমে গেছে।
গত ১৭ মে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘উপকূলের ইলিশ ও জেলে’ শীর্ষক এক জাতীয় সংলাপে ইলিশ উৎপাদনে ধস নামার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।
ওই সংলাপের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ আলী হঠাৎ ইলিশ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, ইলিশ সংবেদনশীল মাছ। বাসস্থানে পরিবর্তন অনুভব করলে ইলিশ খুব ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তন করে। কলাপাড়ার রামনাবাদ নদী ও বরগুনার পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর মোহনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ছাড়াও ইলিশের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রগুলোয় বিভিন্ন উন্নয়ন ও শিল্প প্রকল্প নেওয়ায় নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। এগুলো ইলিশকে পথ পরিবর্তনে বাধ্য করছে। তাই উৎপাদনে বড় প্রভাব পড়েছে। তিনি আরও বলেন, জাটকা সুরক্ষায় গত কয়েক বছর ব্যাপক উদাসীনতা ছিল।
ভারতে রপ্তানিতে দাম আরও চড়া
দুর্গাপূজা উপলক্ষে বরিশাল থেকে আড়াই শ টন ইলিশ ভারতে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনুমতি পেয়েছে স্থানীয় পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম দফায় গত বুধবার রাতে বরিশাল থেকে ১৯ টন ও শুক্রবার রাতে আরও ১০ টন ইলিশ ভারতে পাঠানো হয়েছে।
ভারতে রপ্তানি করা ইলিশের দাম অবশ্য স্থানীয় বাজারের চেয়ে কম। রপ্তানি করা ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রাম আকারের ইলিশ বরিশালের পোর্ট রোড বাজারে ৫৮ হাজার টাকা মণ বা ১ হাজার ৯০ টাকা (১০ ডলার) কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। একই আকারের ইলিশ স্থানীয় লোকজনকে কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ টাকা কেজিতে।
ভারতে ইলিশ রপ্তানির আগে ১ কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের প্রতি মণ ইলিশের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৪ হাজার টাকা। রপ্তানি শুরুর পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা।
আর ৭৫০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের প্রতি মণ ইলিশ আগে বিক্রি হতো ৫২ থেকে ৫৪ হাজার টাকা, যা রপ্তানি শুরুর পর বেড়ে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের প্রতি মণের দাম ছিল ৪০ হাজার থেকে ৪৪ হাজার টাকা, যা বেড়ে হয়েছে ৪৮ থেকে ৫৪ হাজার টাকা।
গত বছরও ভারতে ইলিশ রপ্তানির পর দাম বেড়েছিল। তখন রপ্তানির আগে এক কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের ইলিশের মণপ্রতি দাম ছিল ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। রপ্তানি শুরুর পর তা বেড়ে হয়েছিল ৪৪ থেকে ৫০ হাজার টাকা মণ। ৭৫০ থেকে ৯০০ গ্রামের ওজনের প্রতি মণের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা, যা বেড়ে হয়েছিল ৩৮ থেকে ৪২ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের প্রতি মণ ইলিশ ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা ছিল, যা ৩২ থেকে ৩৬ হাজার টাকায় উঠেছিল।