ডা: মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
যেখানে খাদ্য ও আবাসস্থলের প্রতুলতা আছে সেইসব স্থানে ইঁদুর (জধঃ ্ সরপব) একটি বড় সমস্যা। পশুপাখি বা মানুষের খাবার বা এর উচ্ছিষ্টাংশকে এরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং সংক্রমিত করে (আমেরিকায় যার ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৫ টঝউ সমপরিমাণ শস্য/ইঁদুর/বছর)। এইসকল প্রাণীর অবিশ্বাস্য অভিযোজন ক্ষমতা এবং চলন গতি দ্রুততার জন্য এদের থেকে পরিত্রাণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। ইঁদুর উলম্ব পৃষ্ঠে দৌড়াতে পারে, সরু তারের উপর দিয়ে অনায়াসে চলতে পারে এবং ভূমি হতে ১ ফুট পর্যন্ত লাফ দিতে পারে। বাংলাদেশে সাধারণত ২ ধরনের ইঁদুর খামারে বেশি দেখা যায় যেমনঃ ধেড়ে ইঁদুর এবং নেংটি ইঁদুর
ইঁদুরের উপস্থিতি
খামারে ইঁদুরের উপস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমেরিকার ওন্টারিও তে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৮০% পোল্ট্রি খামারি এবং ৮৯% শুকর খামারে ইঁদুরের সমস্যা বিদ্যমান। অধিকাংশ খামার বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারগুলোতে ইঁদুর উপদ্রব বেশি এবং অনেকক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন। ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে খামারে ইঁদুরের উপস্থিতি তদারকি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
খামার ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণসমূহ
চলাচল, দেয়ালে আরোহণের শব্দ, চিঁ-চিঁ শব্দ এবং ধুলোযুক্ত অংশে চলাচলের চিহ্ন
দেয়ালে, বিভিন্ন বস্তুর পেছনে এবং খাদ্যের কাছাকাছি মলের উপস্থিতি
মেঝে বা খামারের আশপাশে সদ্য মাটি খোঁড়ার চিহ্ন ইঁদুরের গর্ত নির্দেশ করে।
কামড় বা চিবানোর চিহ্ন এবং বোর্ড বা কাঠের উপর, খুঁটি, মাচা, কার্নিশে কাঠের গুঁড়া দেখা যাবে।
ইঁদুরের উটকো গন্ধ সার্বক্ষণিক ইঁদুরের উপস্থিতির একটি লক্ষণ।
চোখে দেখে সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলে দিনের আলোতে প্রায়ই ইঁদুর দেখা যায়। প্রচলিত একটি থাম্বরুল (ঞযঁসন জঁষব) যে, যদি একটি ইঁদুর দেখা যায় তার মানে ঐখানে ২০-২৫টি ইঁদুর (জধঃ/গরপব) আছে।
ইঁদ্ুর যেভাবে ক্ষতি করে-
আবাসনের বা খামারের ক্ষতি : এরা খামার স্থাপনার কাঠ এবং বৈদ্যুতিক সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইঁদুর (জড়ফবহঃং) ঘর এবং ফার্ম বিল্ডিং এবং খাদ্য সংরক্ষণাগারের কাঠামো এবং ঘরের অভ্যন্তরস্থ উপাদানের প্রভূত/গুরুতর ক্ষতিসাধন করে
ইনসুলেশন এর ক্ষতি : খামারের সবধরনের আস্তরণ করে বাসস্থান অল্পসময়ে নষ্ট করে ফেলে।
খাদ্য গ্রহণ : ১০০টি ইঁদুর বছরে ১ টনের অধিক খাদ্য গ্রহণ করতে পারে
খাদ্য সংক্রমিত/নোংরা করে : প্রাণীর জন্য সরবরাহকৃত খাদ্য ও সংরক্ষিত শস্য গ্রহণ এবং দূষিত করার জন্য ইঁদুর কুখ্যাত। একটি ইঁদুর যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে তার ১০ গুণ খাদ্য এদের মলমূত্র এবং লোম দ্বারা নোংরা বা সংক্রমিত করে। একটি ধেড়ে ইঁদুর বছরে ২৫,০০০ এবং নেংটি ইঁদুর ১৭,০০০ মল তৈরি করতে পারে! যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ইঁদুর ২ বিলিয়ন টঝউ এর সমপরিমাণ খাদ্যশস্য ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জীবনিরাপত্তা ব্যাহত করে : গবাদিপশু ও পোল্ট্রিতে ইঁঁদুর কমপক্ষে ৪৫টি রোগের বাহক হিসেবে স্বীকৃত, যেমন- সালমোনেলোসিস, পাস্চুরেলোসিস, লেপটোস্পাইরোসিস, সোয়াইন ডিসেন্ট্রি, ট্রাইচিনোসিস, টক্রোপ্লাজমোসিস এবং জলাতঙ্ক। এরা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে সাধারণত এদের পায়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।
জুনুটিক রোগসমূহ : ইঁদুর মানুষে বিভিন্ন রোগের জীবাণু নিজে আক্রান্ত হয়ে বা বাহক হিসেবে ছড়িয়ে মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হিসেবে কাজ করতে পারে। যেমন: প্লেগ, সালমোনেলোসিস, ই-কোলাইজনিত ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস-ই, অ্যামিবিক আমাশয় ইত্যাদি।
নিয়ন্ত্রণ
ইঁদুর-প্রতিরোধী খামার স্থাপনা : খামার করার আগে ধারণাগত ও কাঠামোগত জীব-নিরাপত্তার অংশ হিসেবে ইঁদুর প্রতিরোধী খামার স্থাপনা করতে পারলে পরবর্তীতে খামারকে ইঁদুরের প্রবেশ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। ইঁদুর দ্বারা সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে ইঁদুর-নিরোধী স্থাপনা। গবেষণায় দেখা যায়, ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে যদি অসুরক্ষিত ফাঁকা জায়গা বা ছিদ্র থাকে তবে খামারে ইঁদুর পুনঃআক্রমণ করবে। ইঁদুরের লুকানোর জায়গাগুলো দূর করতে হবে।
গুদামঘর, খাদ্য-কক্ষ, সংযুক্ত থাকার জায়গা এবং যেখানে নির্মাণকাজ দুর্বল সেসব জায়গা দেয়াল, মেঝে বা চিলে-কোঠা দিয়ে ইঁদুর প্রবেশ করতে পারে। তাই নির্মাণসামগ্রী ভালো মানের ব্যবহার করে যদি নির্মাণকৌশল ত্রুটিপূর্ণ হয় তবে খামার ইঁদুর-নিরোধী হলেও পরবর্তীতে এরা প্রবেশ করতে পারে। ইঁদুরের বেয়ে উঠা প্রতিরোধ করতে ঘরের কোনায় (১২-১৮ ইঞ্চি) বা বাইরের দিকে ভূমি হতে বাইরের দেয়ালে ৩৬ ইঞ্চি (বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রচলিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি লেয়ার মুরগির ফার্মে) এলুমিনিয়াম শিট মেটাল ব্যান্ড স্থাপন করলে ইঁদুরের প্রবেশ সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
খামারির মালিককে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে কার্যকর ইঁদুর নিরোধন ব্যবস্থা ইঁদুর-মুক্ত খামার স্থাপনার নিশ্চয়তা প্রদান করবে না। ইঁদুর হয়তো চিবিয়ে, ক্ষয় করে নতুন প্রবেশপথ তৈরি করে বা এমনকি কোন তৈজসপত্র বা বাক্সের মাধ্যমে খামার স্থাপনায় প্রবেশ করতে পারে। তাই ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে যার মধ্যে নিয়মিত নজরদারি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, এবং সংখ্যা বা বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত।
খামারে বিদ্যমান ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ
ফাঁদ : ¯œ্যাপ বা বক্স ফাঁদ বেশি ব্যবহৃত হয়। ফাঁদের ভেতরে ইঁদুরের পছন্দনীয় খাবার যেমন পাউরুটি, আলু, শুঁটকি মাছ, মাংস, মাখন, চিজ বা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
গ্লু বোর্ড : এই পদ্ধতি নেংটি ইঁদুরের বিরুদ্ধে খুবই কার্যকর। একটি মাঝারি আকারের পোল্ট্রি বা ডেইরি ফার্মের জন্য অন্তত ৫০-১০০টি গ্লুবোর্ড স্থাপন করতে হয়।
শিকারি প্রাণি : যেমনঃ বিড়াল; এই পদ্ধতিতে অল্প ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
সাউন্ড ও আল্ট্রাসাউন্ড যন্ত্র : বাণিজ্যিক মুরগির খামারে এই পদ্ধতি কার্যকর নয় কারণ অতিরিক্ত শব্দে মুরগি ভয় পায় ফলে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে।
সর্বোপরি ইঁদুর দ্বারা প্রতি বছর লাইভস্টক এবং পোল্ট্রি খামারের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের দেশে প্রতি বছর জাতীয় ইঁদুর নিধন কার্যক্রম হয়ে থাকে। সে লক্ষ্যে লাইভস্টক এবং পোলট্রি খাবারের ইঁদুর দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা জরুরি। জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২৩ সফল হোক।
লেখক : উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (এল/আর), আঞ্চলিক প্রাণিরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগার (এফডিআইএল), সিরাজগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭১৬৪৬০৮৫৩ ই-মেইল :[email protected]