বিগত কয়েক দশকে দেশে চাষের অধীনে মাছের উৎপাদনে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। দেশ মাছ চাষে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। অধিক ঘনবসতির দেশ হওয়ায় দেশের বাজারে যেমন মাছের ক্রমবর্ধমান চাহিদা আছে তেমনি গ্রামীণ বেকার যুবকের আত্মকর্মসংস্থানের অন্যতম মাধ্যম পুকুরে মাছ চাষ। অনুকূল আবহাওয়া, মাছ চাষের সহজ প্রযুক্তি, উপকরণের প্রাচুর্যতা গ্রাম পর্যায়ে মাছ চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে প্রতিনিয়ত। অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে আগামী দিনে বাজারে মাছের চাহিদাও বৃদ্ধিপাবে এটাই স্বাভাবিক। উন্নত দেশের মাথাপিছু মাছ গ্রহণের হার আমাদের চেয়েও অনেক বেশি। আমাদের দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রাকৃতিক নানাবিধ কারণে মাছের উৎপাদন কমে আসছে এবং এর বিপরীতে দেশে বাৎসরিক মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি (২০১৪-১৫ সালে ১৫ কেজি, ২০১৯-২০ সালে ২৩ কেজিতে উন্নীত) পাচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ের মাছ চাষিদের সাথে মতবিনিময়ে প্রাপ্ত তথ্য ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বিদ্যমান অবস্থার মাঝে কী উপায়ে লাভজনকভাবে মাছ চাষ করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
চাষ প্রযুক্তি নির্বাচন
লাভজনক মাছ চাষের জন্য সঠিক মাছ চাষ পদ্ধতি নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চাষিপর্যায়ে অনেক ধরনের মাছ চাষ প্রচলিত আছে। বিদ্যমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে এখানে কয়েকটি লাভজনক মাছ চাষের পদ্ধতি উপস্থাপন করা হলোঃ
বড় আকারের পোনা মজুদ করে কার্প মিশ্রচাষ : সাধারণত ৫-৬ ইঞ্চি আকারের শতকে ৫০-৬০ কার্পজাতীয় মাছের পোনা মজুদ করে মাছ চাষের প্রচলন আছে। কিন্তু বর্তমান এর চেয়ে ভাল পদ্ধতি ৫০০ গ্রাম এর বড় পোনা কম ঘনত্বে (শতকে ১০-১২টি; যাতে ২টি হবে উপরের স্তরের মাছ, ৭টি মধ্যস্তরের রুই এবং নিচের স্তরের ১টি মৃগেল ও ১টি কার্পও এবং সর্বস্তরের ১টি গ্রাসকার্প) ছেড়ে অধিক বড় আকারের মাছ উৎপাদন। যত বড় আকারের পোনা মজুদ করা যাবে তত বেশি বড় আকারের দামি মাছ উৎপাদন করা যাবে।
তেলাপিয়ার সাথে কার্প মিশ্র চাষ : একক মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে অনেকে শতকে ২০০-৩০০ পোনা মজুদ করে চাষ করে থাকেন এটা এখন আর লাভজনক হচ্ছে না। তেলাপিয়া মজুদ কমিয়ে শতকে ১৫০টি (১০ গ্রাম আকারের পোনা) এবং তার সাথে বড় আকারের কাতল ২টি, রুই ৭টি পোনা মজুদ (২৫০-৪০০ গ্রাম ওজনের) করে ৩-৪ মাস চাষ করে যখন তেলাপিয়ার ৩-৪টিতে কেজি হবে তখন ১/৩ ভাগ তেলাপিয়া বিক্রয় করে দিয়ে আবার কয়েক মাস পরে যখন ২টিতে কেজি হবে তখন বাকি ২/৩ ভাগ হতে অর্ধেক তেলাপিয়া মাছ বিক্রয় করে দিতে হবে এবং পরিশেষে অবশিষ্ট তেলাপিয়া প্রত্যেকটি যখন ১ কেজি হবে তখন সম্পূর্ণ মাছ বিক্রয় করে অধিক লাভবান হওয়া যেতে পারে।
শিং, পাবদা এবং গুলসার সাথে কার্প মিশ্রচাষ : শিং, পাবদা ও গুলশা একক চাষে শতকে ১০০০-১৫০০ পোনা মজুদ করে পুকুরে মাছ চাষ প্রচলন আছে । এ ক্ষেত্রে মূল প্রজাতির (ধরুন পাবদা) মাছ কিছুটা কম মজুদ করে (শতকে ৬০০-৭০০টি) সাথে ৩০০-৫০০টি শিং বা গুলসা এবং তার সাথে ১টি কাতল, ৩টি রুই ও ১টি মৃগেল এবং ১৫-২০টি তেলাপিয়া মজুদ করে চাষে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। চাষের সময় ৬-৭ মাসে রুইজাতীয় মাছ ১.৫-২ কেজি হচ্ছে এবং তেলাপিয়া ১ কেজির উপরে বড় হচ্ছে। অনেকে বছরের শুরুতে ৩ মাসে একক কৈ মাছ চাষ করে একটি ফলন তুলে পুকুর পুনরায় প্রস্তুত করে এ পদ্ধতিতে চাষে যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন।
পাংগাস মাছের সাথে অন্য প্রজাতির মাছের মিশ্রচাষ : শতকে ২০০-৩০০টি পোনা মজুদ করে একক পাংগাস চাষ এখন আর নাই বললেই চলে। অনেকেই পাংগাস চাষ সম্পূর্ণ ছেড়েও দিয়েছেন। আবার অনেকে সমস্যার মধ্যে থেকেও চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা একক চাষের পরিবর্তে পাংগাসের সংখ্যা শতকে ৭০-১২০টিতে নামিয়ে সাথে ৫০-১০০টি তেলাপিয়া এবং ৮-১২টি বড় আকারের রুইজাতীয় মাছের পোনা মজুদ করে চাষ করছেন এবং লাভবান হচ্ছেন। এখানে পাংগাস মাছকে লক্ষ করে গরম কালে ডুবন্ত বা ভাসমান এবং শীতে ভাসমান খাবার প্রয়োগ করে বছরে একটি ফসল চাষ করছেন। এক্ষেত্রে একক পাংগাস চাষের থেকে বিনিয়োগ কমে আসছে এবং মোট উৎপাদন কম হলেও চাষি লোকসানের হাত থেকে মুক্ত হয়ে লাভজনকভাবে মাছ চাষ করতে পারছেন। পাংগাস মাছ বিক্রয়ে বিনিয়োগ উঠছে এবং অন্য প্রজাতির মাছসমূহ বিক্রয়ের অর্থ সম্পূর্ণটা লাভ হচ্ছে।
কার্পজাতীয় মাছের সাথে অন্যান্য মাছের মিশ্রচাষ : প্রথমে কার্পজাতীয় মিশ্র চাষের সাথে শিং অথবা পাবদা অথবা গুলসা শতকে ৫০০-৭০০টি মজুদ করে সান্ধ্যকালীন এ মাছের জন্য নির্ধারিত পৃথক খাবার প্রয়োগ করেও সফলভাবে মাছ চাষ করা যেতে পারে।
গলদা চিংড়ি ও কার্প মিশ্রচাষ : কার্প মাছের সাথী ফসল হিসাবে গলদা চিংড়ি চাষ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কার্পজাতীয় মাছ মজুদের আগে শতক প্রতি ৭০-১০০টি হারে গলদা চিংড়ির পিএল ছেড়ে একমাস নার্সারিং করার পরে কার্পজাতীয় মাছ মজুদ করতে হবে। বাজারে এ মাছের ব্যাপক চাহিদার কারণে দাম পাওয়া যায় ভাল।
মাছ চাষ সম্পর্কে সঠিক ধারণা গ্রহণ
মাছ চাষের একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা গ্রহণ করে চাষে নামতে হবে। শুরুতে স্বল্প পরিসরে মাছ চাষ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে বড় পরিসরে যেতে হবে।
উপযুক্ত পুকুর নির্বাচন
যে প্রজাতির মাছ চাষ করা হবে তার জন্য উপযুক্ত পুকুর নির্বাচন করতে হবে। সব পুকুরে সব ধরনের মাছ চাষ করা যায় না। যেমন কৈ মাছ চাষের জন্য নিয়মিত পুকুরের পানি বের করে দেবার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পর্যাপ্ত আলো বাতাস সমৃদ্ধ উন্মুক্ত জায়গাতে কার্পজাতীয় মাছসহ পাবদা, গুলসা, চিংড়ি চাষ করলে ভাল হবে। কিছুটা ছায়াযুক্ত জায়গা হলেও শিং, তেলাপিয়া বা শোল মাছ চাষ করা যায়। পুকুরে পানির গভীরতা সব সময় ৬-৭ ফুট হতে হবে। কম গভীরতার পুকুরে মাছ চাষ হয় তবে রোগ-ব্যাধিসহ অন্যান্য সমস্যা বেশি দেখা দেয়। বেশি গভীর পুকুরে পাংগাস মাছ ভাল হলেও অন্যান্য মাছের ফলন ভাল হয় না।
মাছ চাষের সময় নির্বাচন
বছরের সব সময় বাজারে মাছের দাম একই রূপ থাকে না। এজন্য মাছ কখন চাষ শুরু করতে হবে কখন বিক্রয় করতে হবে সে বিষয়ে আগেই হিসাব করে মাছ চাষ করতে হবে। সাধারণত মার্চ মাসের দিকে মাছের দাম বাড়তে থাকে এবং আগস্ট পর্যন্ত দাম ভাল থাকে এসময় মাছ বিক্রয় করা যাবে এভাবে হিসাব করে মাছ চাষ করতে হবে
পুকুরে মাছ চাষের ঘনত্ব
মাছ চাষে একেক প্রজাতির মাছ একেক ঘনত্বে মজুদ করতে হয়। তবে চাষের পুকুরে মাছের ঘনত্ব, মাছের উৎপাদন এবং প্রয়োগকৃত খাদ্যের খাদ্য রূপান্তর হারের (ঋঈজ) একটি সম্পর্ক আছে। মাছের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে মাছের মোট উৎপাদন বেশি করা সম্ভব কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রয়োগকৃত খাদ্যের রূপান্তর হার ভাল হয় না, ফলে মাছ চাষে লাভ কমে যেতে পারে। মাছ চাষে উপযুক্ত ঘনত্বের বেশি মাছ ছাড়লে পুকুরের পরিবেশের উপর প্রভাব পড়ে এবং পরিবেশ ভাল রাখার জন্য নানা প্রকার ব্যবস্থাপনার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় এর ফলে চাষ ব্যবস্থাপনার খরচ বেড়ে যায়, মাছের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতেও পারে।
মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা
মাছ চাষে মোট বিনিয়োগের ৭০% অধিক খাদ্য খরচ হয়। সে জন্য কোন খাদ্য প্রয়োগ করলে মাছ চাষে লাভ করা যাবে তা মাছের বাজার দর, মাছের প্রজাতি ও চাষ পদ্ধতি বিবেচনায় রেখে নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমান সময়ে মাছের বাজার দর বিষয়টিকে আরো কঠিন করে তুলেছে। বিদ্যমান অবস্থার মাঝে মাছ চাষিকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মাছের খাদ্য নির্বাচন করতে হবে।
মাছ চাষের পুকুরের পানি পরিবর্তন
আধুনিক মাছ চাষ সম্পূর্ণভাবে, পুকুরের পানি ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। মাছ চাষের পুকুরে প্রতিদিন খাবার প্রয়োগ করতে হয়। মাছ পুকুরের পানিতেই পায়খানা করে। অবশিষ্ট খাবার এবং মাছের পায়খানার (ঊীপৎবঃধ) কারণে পুকুরের পানি সহজে ভারী হয়ে দূষিত হয়ে যায়। পানি পরিবর্তন করলে পুকুরের এ সমস্যাসহ অনেক সমস্যাই সহজে সমাধান করা যায়। মাছের যে কোন রোগ দেখা দিলে পানি পরিবর্তন সর্বোত্তম সমাধান। শীতের সময় পুকুরে পানি দিতে পারলে মাছ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং খাবার গ্রহণ হার বৃদ্ধি পায়। পুকুরের পানির অক্সিজেন মাত্রা বাড়াবার সহজ উপায় পুকুরে পানি সরবরাহ। তবে সরবরাহকৃত পানি অবশ্যই আয়রন মুক্ত হতে হবে।
মাছ চাষের পুকুরে এ্যারেটর স্থাপন
মাছ চাষের পুকুরে এ্যারেটর সংযোজন করতে পারলে নিরাপদ মাছ চাষে কয়েকধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়। মাছ চাষের পুকুরে দ্রবণীয় অক্সিজেনের অভাব একটি সাধারণ সমস্যা। যান্ত্রিক এ্যারেটর এ সমস্যা দূর করা ছাড়াও পুকুরের সাধারণ অক্সিজেনের মাত্রা (৫ পিপিএম) বাড়িয়ে দেয় ফলে মাছের খাদ্য গ্রহণ হারসহ খাদ্যের হজম হার বৃদ্ধি পায়। মাছের শরীরে খাদ্যের আত্ত্বীকরণ (অংংরসরষধঃরড়হ) বৃদ্ধি পায় ফলে সার্বিকভাবে খাদ্যের ঋঈজ এর মান ভাল হয়। ফলে কম খাবারে মাছের অধিক উৎপাদন পাওয়া যায়।
নিয়মিত প্রবায়োটিক্স ব্যবহার
বর্তমান মাছ চাষে প্রবায়োটিক্সের ব্যবহার মাছের পুকুরের পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। প্রবায়োটিক্স হচ্ছে পুকুরে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির উপকরণ। মাছ চাষের পুকুরের তলদেশে প্রতিনিয়ত জৈব পচনশীল দ্রব্য জমতে থাকে। এই জৈব পদার্থ পুকুরের তলদেশে পচে ক্ষতিকর গ্যাসের সৃষ্টি হয় এবং পুকুরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হতে পারে। প্রবায়োটিক্স প্রয়োগের ফলে পুকুরে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার পর্যাপ্ত সৃষ্টি হওয়ার কারণে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া উৎপাদন প্রতিহত হয়। পুকুরের পরিবেশ উন্নয়ন এবং মাছ চাষকে নিরাপদ রাখার জন্য বাজারে প্রাপ্ত যে কোন প্রবায়োটিক্স ২০-২৫ দিন পরপর প্রয়োগ করতে হবে। প্রবায়োটিক্স বাজারে দুই ধরনের আছে, কিছু আছে ব্যবহারের আগে চিনির পানিতে ২৪ ঘণ্টা প্রতিপালন করে ব্যবহার করতে হয়। আর কিছু আছে পুকুরে সরাসরি প্রয়োগ করতে হয়। প্রবায়োটিক্স প্রয়োগের পর পুকুরে কোন প্রকার ব্যাক্টেরিয়া নাশক (ঝধহরঃরুবৎ) প্রয়োগ করা যাবে না।
বর্তমান সময়ে একটু চিন্তাভাবনা করে মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে চাষের প্রযুক্তি নির্ধারণ করে একনিষ্ঠভাবে ধৈর্যসহকারে এগিয়ে গেলে যে কেউ মাছ চাষে সফলতা লাভ করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : বিভাগীয় উপপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, রাজশাহী বিভাগ, রাজশাহী। মোবাইল : ০১৭৫১৯৩৯৯৩২ প্রেরকঃমোঃ মেহেদী হাসান (বরিশাল)